অ্যাপশহর

বেলাগাম বিলে নজরদারির ভাবনা

বিল দেখেই অরূপবাবু প্রথম জানাতে পারেন, প্রতি দিন নাকি তিন জন করে চিকিত্সক পরীক্ষা করেছিলেন তাঁকে৷

EiSamay.Com 17 Feb 2017, 8:36 am
এই সময়: গিরিশ পার্কের অরূপ ভৌমিক টানা তিন দিন জ্বরে ভুগছিলেন৷ ডাক্তারের সুপারিশে ভর্তি হন স্থানীয় নামকরা এক বেসরকারি হাসপাতালে৷ ভাইরাল জ্বর হওয়ায় দিন চারেকের মধ্যে ছুটিও পেয়ে যান৷ তবে ছুটির সময়ে হাসপাতালের বিলের অঙ্কে ফের জ্বর এসে যাওয়ার জোগাড় হয়৷ চার দিনে বিল দাঁড়িয়েছিল এক লাখ ২৫ হাজার টাকা৷ রক্ষে এই যে, ক্যাশলেস মেডিক্লেম ছিল৷ তবে বিল খুঁটিয়ে দেখতে চমকের আর বাকি ছিল না ভৌমিক পরিবারের৷ হাসপাতালের দাবি, প্রতি দিনই নাকি দশ রকমের রক্ত পরীক্ষা হয়েছে দু’বেলা! একই দিনে একটা নির্দিষ্ট রক্ত পরীক্ষা হয়েছে নাকি চার-চার বার৷ এতেই ২৫ হাজার টাকার মতো বাড়তি বিলের বন্দোবস্ত৷ বিল দেখেই অরূপবাবু প্রথম জানাতে পারেন, প্রতি দিন নাকি তিন জন করে চিকিত্সক পরীক্ষা করেছিলেন তাঁকে৷
EiSamay.Com rate on medicine sector going high
বেলাগাম বিলে নজরদারির ভাবনা


এর জন্যও বাড়তি বিল হাজর কুড়ির! যাদবপুরের সহিদুল চৌধুরী মাস ছ’য়েক আগে সন্ধে বেলায় বুকে প্রচণ্ড ব্যথা আর শ্বাসকষ্ট নিয়ে ভর্তি হয়েছিলেন আলিপুরের একটি বেসরকারি হাসপাতালে৷ হূদযন্ত্রে কোনও ত্রুটি আছে কি না--তা যাচাই করতে শুরু হয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা৷ ভর্তির মুহূর্ত থেকেই৷ সমস্ত পরীক্ষার পর কোনও ত্রুটিই পাননি ডাক্তারেরা৷ দ্বিতীয় দিন সিদ্ধান্ত হয়, আরও কিছু পরীক্ষা করাতে হবে৷ নিশ্চিত হওয়ার জন্য করা হয় অ্যাঞ্জিয়োগ্রামও৷ আরও এক দফা রক্ত পরীক্ষা৷ তৃতীয় দিন সমস্ত রিপোর্ট দেখে ডাক্তার জানান, কোনও সমস্যা নেই৷ ওই দিন বিকেলেই ছুটি হয়ে যায় পঞ্চাশোর্ধ্ব সহিদুলের৷ এ ক্ষেত্রেও বিল দেখে চমকে ওঠেন রোগীর পরিজন৷ নজরে আসে, বিলের সিংহভাগ জুড়েই বিস্তর রক্ত পরীক্ষার হিসাব৷ দু’দিনেই বিল ছুঁয়ে ফেলেছে লাখের ঘর৷ সহিদুলের পরিবার কোনও রকমে নগদ জোগাড় করে বিল মিটিয়ে বাড়ি ফেরেন৷ কোনও রোগ নেই, রোগ খুঁজতেই বেরিয়ে যায় লাখখানেক! ডাক্তারকে প্রশ্ন করেও অগুনতি রক্ত পরীক্ষার কারণ জানতে পারেননি ওঁরা৷

শহরের নামজাদা বিভিন্ন কর্পোরেট হাসপাতালের বাইরে দাঁড়ালে প্রতি দিনই এমন নমুনা মিলবে ভূরি-ভূরি৷ কান পাতলেই শোনা যাবে বিলের অঙ্ক নিয়ে বিস্তর অভিযোগ৷ বিল বাঁড়ানোর বিচিত্র সব কৌশলে থ’ হয়ে যাওয়ারই জোগাড়৷ অনেক ক্ষেত্রেই এই বিল মেটানো নিয়েই বিবাদে জড়ান হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ও রোগীর পরিজন৷ ওয়াকিবহাল মহলের ব্যাখ্যা, বুধবার সিএমআরআই হাসপাতালের গোলমালের পিছনেও রয়েছে সেই টাকার প্রশ্নই৷ অভিযোগ, অপারেশনের আগেই হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ দেড় লাখ টাকা জমা করতে বলেছিলেন কিশোরী মুসকানের পরিবারকে৷

হাসপাতালের এই লাগামহীন বিলের প্রবণতা এবং পরিষেবায় গাফিলতি ও প্রতিশ্রীতি ভঙ্গের অভিযোগে জেরবার রাজ্য সরকার অবশেষে নড়েচড়ে বসতে চলেছে৷ রাজ্যের ক্রেতা সুরক্ষা দন্তর কর্পোরেট হাসপাতালের কর্তাদের নিয়ে বৈঠকে বসতে চলেছেন৷ সেই সঙ্গেই সরকার আর একটি বিষয়ও কর্পোরেট হাসপাতালগুলির কর্তৃপক্ষকে মনে করিয়ে দিতে চাইছেন৷ বহু ক্ষেত্রেই স্বল্পমূল্যে হাসপাতালের জন্য জমি দেয় সরকারই৷ ‘রিসার্চ ইনস্টিটিউটে’র তকমা ব্যবহার করে কেন্দ্রীয় সরকারের কাছ থেকেও যন্ত্রপাতি আমদানিতে শুল্ক ছাড় আদায় করে নেয় এই সব হাসপাতাল৷ বিনিময়ে ন্যূনতম ১০ শতাংশ বেডে একদম বিনি পয়সায় পরিষেবা দিতে দায়বদ্ধ হাসপাতালগুলি৷ কিন্ত্ত সেই দায় নেয় না প্রায় কোনও হাসপাতালই৷ বা নানা ছুতোয় এড়িয়ে যায়৷ এ বার সেই হিসাব বুঝে নিতে চাইছে রাজ্য৷

বেসরকারি হাসপাতালের পরিষেবার মান এবং বিশেষত বেলাগাম বিল নিয়ে অসন্তোষ টের পাওয়া গিয়েছে বিধানসভাতেও৷ খোদ কয়েক জন বিধায়কই পরিষেবা ও বিলের অঙ্ক নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন৷ স্পিকার বিমান বন্দ্যোপাধ্যায়ও দিন কয়েক আগে বেসরকারি হাসপাতালের বিল নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেন৷ বিধানসভা সূত্রের খবর, এ ব্যাপারে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গেও কথা বলেছেন স্পিকার৷ মুখ্যমন্ত্রীর হাতেই রয়েছে স্বাস্থ্য দন্তর৷ সূত্রের খবর, এর পরই মুখ্যমন্ত্রী দন্তরের আমলাদের চিন্তাভাবনা করতে বলেন৷ প্রয়োজনে মুখ্যমন্ত্রীও কর্পোরেট হাসপাতালের কর্তাদের নিয়ে বৈঠক ডাকতে পারেন বলে খবর৷ বৃহস্পতিবার স্পিকার বলেন, ‘সরকারকেই নিয়ম করে বেসরকারি হাসপাতাল ও নার্সিংহোমের বেপরোয়া বিলে লাগাম টানতে হবে৷’

তবে স্বাস্থ্য দপ্তরের বক্তব্য, ক্লিনিক্যাল এস্টাবলিশমেন্ট অ্যাক্টে চিকিত্সার খরচের বিষয় অন্তর্ভুক্ত নয়৷ আইনের বাইরে গিয়ে স্বাস্থ্য দন্তরের কাজ করাও অসম্ভব৷ ফলে, বিলের মধ্যে কোনও কারচুপি থাকলে তা যাচাই করে শাস্তি দেওয়ার ক্ষমতা স্বাস্থ্য ভবনের নেই৷ অগত্যা, অধিকাংশ রোগীর পরিজনই বাধ্য হন অত্যাচার মুখ বুজে মেনে নিতে৷ কিন্ত্ত মঙ্গলবার হাসপাতালে ভাঙচুরের ঘটনায় যেমন উদ্বেগ বেড়েছে, তেমনই চিকিত্সা প্রতিষ্ঠানের অনাচার নিয়েও সরকারি মহলে চিন্তা এক ধাক্কায় অনেকটাই বেড়ে গিয়েছে৷

বৃহস্পতিবারই মুখ্যমন্ত্রীর দপ্তর থেকে সরকারি কর্মচারীদের মেডিক্লেম পলিসি নিয়ে বেসরকারি হাসপাতালের বিরুদ্ধে ওঠা অনিয়মের অভিযোগ খতিয়ে দেখার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে৷ মুখ্যমন্ত্রীর অফিসের এক অফিসার বলেন, ‘আমরা এমন অভিযোগও পেয়েছি যে, হাসপাতালের এক বিল্ডিং থেকে আর এক বিল্ডিংয়ে নিয়ে যেতে অ্যাম্বুল্যান্স ভাড়া বাবদ বিপুল টাকা দেখানো হয়েছে৷ এক সরকারি কর্মীর চিকিত্সা শুরুর আগে ৮০ হাজার টাকার প্যাকেজের কথা বলা হয়েছিল৷ পরে তাঁর হাতে দেড় লাখ টাকার বিল ধরানো হয়৷ অতিরিক্ত বিলে তুলো, গজ বাবদও মোটা টাকা চার্জ করা হয়েছে৷’

এই অবস্থাতেই ক্রেতা সুরক্ষা দন্তর আগামী ২২ ফেব্রুয়ারি বেসরকারি হাসপাতালের সব কর্তাদের নিয়ে বৈঠকে বসতে চলেছে৷ দন্তরের মন্ত্রী সাধন পাণ্ডে বলেন, ‘লাগামহীন বিল নিয়ে বিস্তর অভিযোগ রয়েছে৷ বৈঠকের রির্পোট স্বাস্থ্য দন্তরকেও পাঠানো হবে৷’ একই ভাবে বিধনাসভার স্পিকার বিমান বন্দ্যোপাধ্যায়ও বিশেষ কমিটি গড়েছেন৷ যার মূল কাজ হবে বিধায়কদের বেসরকারি হাসপাতালে চিকিত্সার বিলগুলো পরীক্ষা করা৷ ওই কমিটিও বেসরকারি হাসপাতালের আধিকারিকদের ডেকে কথা বলা শুরু করেছে৷ স্পিকার কমিটিকে দ্রুত রিপোর্ট জমা দিতেও বলেছেন৷ ওই রিপোর্টের ভিত্তিতে স্পিকারও সরকারকে বেসরকারি হাসপাতালের বিলে রাশ টানার সুপারিশ করতে পারেন৷

পরের খবর

West bengal newsসম্পর্কে আরও বিস্তারিত ও নতুন খবর জানতে ক্লিক করুন। সব ধরনের ব্রেকিং, আপডেট এবং বিশ্লেষণ সবার প্রথম বাংলায় পড়তে ক্লিক করুন Bengali Newsএই সময় ডিজিটাল