জনজাতির স্বতন্ত্রতা না থাকলে সেই জাতি গোলামে পরিণত হয়। আজ কুড়মি সমাজের (Kurmi Community) স্বতন্ত্রতা বিপন্ন। এমনই দাবিতে এবং তপশিলি উপজাতিভুক্ত তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা দাবিতে বৃহত্তর আন্দোলনে সামিল হয়েছে বাংলার কুড়মি সম্প্রদায়। যদিও কুড়মি জনজাতির এই আন্দোলন নতুন নয়। দীর্ঘ ৫০ বছরের বেশি সময় ধরে আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে কুড়মি সম্প্রদায়। কিন্তু, কোনও সুরাহা হয়নি। তাই এবার লাগাতার রেল রোকো অভিযানে নেমেছে বাংলার কুড়মি সম্প্রদায়। শুধু আন্দোলনের সঙ্গে যুক্তরা নয়, এই আন্দোলন "দীর্ঘদিনের বঞ্চনার ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ" বলে 'এই সময় ডিজিটাল'-কে জানাচ্ছেন রাঁচি বিশ্ববিদ্যালয়ের আদিবাসী ও আঞ্চলিক ভাষা বিভাগের কুড়মালির প্রাক্তন গবেষক ড. এস. এন সিং।
কুড়মি সমাজের ইতিহাস
কুড়মি সম্প্রদায়ের ইতিহাস তুলে ধরে কুড়মালি সম্প্রদায়ের প্রাক্তন গবেষক ড. এস. এন সিং জানান, ঝাড়খণ্ড, মানভূম সহ সংলগ্ন অঞ্চলের ভূমিপুত্র হল কুড়মি সম্প্রদায়। যখন সেভাবে জনবসতি গড়ে ওঠেনি, চারদিকে জঙ্গলে ঘেরা ছিল, সেই সময়ে পশ্চিমপ্রান্ত থেকে বাংলা, বিহার, বর্তমান ঝাড়খণ্ড সহ বিস্তীর্ণ অঞ্চলে বসবাস শুরু করে কুড়মি জনজাতি গোষ্ঠী। অসম, এমনকী দক্ষিণ ভারতে ছোটো নাগপুর মালভূমি এলাকাতেও এই জনজাতির বাস রয়েছে।
বাংলায় মূলত কংসাবতী নদীর (Kangsabati River) তীরেই কুড়মি জনজাতির (Kurmi Community ) বসবাস ছিল। কুড়মিদের বিভিন্ন লোকগানে সেই নদীর উল্লেখ পাওয়া গিয়েছে। কুড়মি জনগোষ্ঠীর লোকেরাই জঙ্গল কেটে চাষাবাদ শুরু করে বসতি স্থাপন করে। ইতিহাসেও এই গোষ্ঠীর বিশেষ উল্লেখ রয়েছে। গোড়ায় কুড়মি জনজাতির লোকেদের 'অচ্ছুৎ' বলে দূরে সরিয়ে রাখত তথাকথিত শিক্ষিত সমাজ। পরবর্তীতে সমাজের প্রয়োজনে কুড়মি জনজাতিকে ক্ষত্রিয়ের মর্যাদা দেন তৎকালীন ময়ূরভঞ্জ জেলার রাজা। পরবর্তীতে কুড়মি সম্প্রদায়ের অনেকেই নিজেদের নামের সঙ্গে মাহাতো পদবি যুক্ত করে। অনেকে আবার মহন্ত পদবি নেয় আবার অসমে পদবি হিসাবে কুড়মি রেখেছে এই জনগোষ্ঠীর লোকজন।
কুড়মিদের আন্দোলনের কারণ কী?
কুড়মি জনজাতি ধীরে-ধীরে তাদের কাজের মধ্য দিয়ে সমাজে উঠে এলেও তাদের সাংবিধানিক স্বীকৃতি অধরা। ড. এসএন সিং জানান, সংবিধান সংশোধনের গোড়ার দিকে ভারত সরকার কুড়মি জনজাতিকে তপশিলি সম্প্রদায়ভুক্ত করেছিল। কিন্তু, কয়েক মাসের মধ্যেই কোনও এক অজ্ঞাত কারণে কুড়মি জনজাতিকে তপশিলি তালিকা থেকে বহিষ্কৃত করা হয়। তারপর থেকেই নিজেদের স্বতন্ত্রতা আদায় করতে আন্দোলন শুরু করে কুড়মি জনজাতি। পুনরায় তপশিলি তালিকায় অন্তর্ভুক্তিকরণের দাবিতে বহুবার কেন্দ্রীয় সরকারকে স্মারকলিপি দিয়েছে কুড়মি জনজাতি। কিন্তু, তাদের সেই দাবি আজও পূরণ হয়নি। তাই এবার লাগাতার 'রেল রোকো' অভিযানের মাধ্যমে বৃহত্তর আন্দোলনে সামিল হল।
কেবল বাংলায় কেন আন্দোলন?
বিভিন্ন রাজ্যে কুড়মি জনগোষ্ঠী থাকলেও বর্তমানে কেবল বাংলার কুড়মি জনজাতি এই আন্দোলনে সামিল হয়েছে। পার্শ্ববর্তী রাজ্য বিহার (Bihar), ঝাড়খণ্ড (Jharkhand) বা অসমে (Assam) এর কোনও প্রভাব পড়েনি। এ প্রসঙ্গে বাংলায় কুর্মিদের ‘মূল খুঁটি মূল মানতা’ (দলনেতা) অজিত মাহাত 'এই সময় ডিজিটাল'কে বলেন, "পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বিশেষভাবে আমাদের আন্দোলনকে সমর্থন জানিয়েছেন। তিনটি রাজ্যের মধ্যে একমাত্র পশ্চিমবঙ্গ সরকার, মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আমাদের আন্দোলনকে সমর্থন জানিয়ে, আমাদের হয়ে সুপারিশ করে কেন্দ্রকে চিঠি দিয়েছেন। তাই এই রাজ্য থেকেই আমরা বৃহত্তর আন্দোলনে সামিল হয়েছি।"
যদিও পশ্চিমবঙ্গ সরকার আন্দোলন তুলে নেওয়ার আবেদন জানিয়েছে। কিন্তু, পশ্চিমবঙ্গ সরকার এখনও পর্যন্ত CRI রিপোর্ট দেননি। যা নিয়ে ক্ষুব্ধ কুড়মি সম্প্রদায়। অজিত বলেন, "উনি আমাদের সুপারিশ করে কেন্দ্রকে চিঠি পাঠিয়েছেন। কিন্তু, এখনও পর্যন্ত CRI রিপোর্ট দেননি। আমাদের আন্দোলনে তুলে নিয়ে আলোচনায় বসতে বলেছেন। কিন্তু, CRI রিপোর্ট না পাওয়া পর্যন্ত আমরা আন্দোলন তুলব না। সরকার চাইলে এখানে এসে আলোচনায় বসুক।" রেল রোকো আন্দোলনের জেরে সাধারণ মানুষের অসুবিধা হচ্ছে স্বীকার করে ক্ষমাও চেয়েছেন তিনি। কিন্তু, আর কোনও উপায় নেই জানিয়ে কেন্দ্রের বিরুদ্ধে সুর উঁচিয়ে অজিত মাহাত জানান, ২ কোটি কুড়মিদের স্বতন্ত্রতা হারাতে বসেছে। জাতির স্বতন্ত্রতা হারালে গোলামে পরিণত হয়। তাহলে কি কুড়মিদের গোলামে পরিণত করতে চাইছে।
ঠিক কী কী দাবিতে আন্দোলন?
মূলত তিনটি দাবি রাখা হয়েছে। প্রথমত, কুড়মিজাতিকে ST তালিকাভুক্ত করতে হবে। দ্বিতীয়ত, কুড়মালি ভাষাকে পাঠ্য করতে হবে এবং তৃতীয়ত, সারনা ধর্ম চালু করতে হবে।
সরকারের প্রতিক্রিয়া কী?
টানা কয়েকদিন ধরে পুরুলিয়া, পশ্চিম মেদিনীপুর, ঝাড়গ্রাম জেলায় কুড়মি সম্প্রদায় ‘রেলটেকা’ ও ‘ডহরছেঁকা’ আন্দোলন চালালেও কেন্দ্রের তরফে প্রতিক্রিয়া মেলেনি। কেন্দ্রকে কটাক্ষ করে রাজ্যের পরিবহণমন্ত্রী স্নেহাশিস চক্রবর্তী জানান, কেন্দ্রীয় সরকারে যারা রয়েছে তারা আদিবাসী দলিতদের প্রতি সহানুভূতিশীল নয়। BJP পরিচালিত বেশ কয়েকটি রাজ্যে আদিবাসী, দলিত বিশেষ করে মহিলারা অত্যাচারিত। এই আন্দোলনে কেন্দ্রীয় সরকার কতটা খেয়াল রাখছে তা তাঁর জানা নেই। তবে এ রাজ্যে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সরকারের আমলে আদিবাসী মানুষ বিভিন্ন প্রকল্পের মাধ্যমে সুযোগ সুবিধা পেয়েছেন।
এবার কুড়মিদের আন্দোলন যে পর্যায়ে পৌঁছেছে, শেষ পর্যন্ত তাদের দাবি মান্যতা পায় কিনা সেটাই দেখার!