এমনকী নিরামিষও নয়, ভেগান। আরও নিরামিষ? ব্যাপারটা কী? খাদ্যের নয়া রাস্তা। দুনিয়ায় ক্রমশ ছড়াচ্ছে এই পেটপুজোর রীতি। ভারতেও। বঙ্গভূমিই বা বাদ যায় কি করে? খোঁজ নিলেন সৌমী দত্ত
শব্দটার সঙ্গে বছর কয়েক আগেও খুব একটা পরিচিত ছিল না কল্লোলিনী কলকাতা৷ ‘ভেজিটেরিয়ান ’ শব্দের প্রথম তিনটি ও শেষ দু’টি অক্ষর নিয়ে তৈরি ‘ভেগান ’, কিন্ত্ত তাঁদের পরিচিতি শুধু নিরামিশাষি নয়৷ খাবার, পোশাক বা বিনোদনের জন্য কোনও প্রাণীর ব্যবহার কোনও ভাবেই সমর্থন করেন না ভেগানরা৷ আর সেই কারণেই তাঁদের ডায়েট চার্ট থেকে বাদ মাছ , মাংস , ডিম থেকে শুরু করে ডেয়ারি দ্রব্য৷ পোশাকের তালিকা থেকে বাদ পশম বা সিল্ক৷ চিড়িয়াখানা , অ্যামিউজমেন্ট পার্ক বা সার্কাসে যান না তাঁরা৷ আমজনতার চোখে রীতিমতো কৃচ্ছ্রসাধন৷
কিন্ত্ত আমার -আপনার মতো মধ্যবিত্ত বাড়ির ছেলেমেয়েরাও সেই কৃচ্ছ্রসাধনের পথে এগোচ্ছে৷ কলকাতায় ভেগানের সংখ্যা এখন নেহাত কম নয়৷ আর তাঁদের অধিকাংশেরই বয়স ১৬ থেকে ৪০ -এর মধ্যে ! মাংস বা ডেয়ারি দ্রব্য না খেলে স্বাস্থ্যের কোনও ক্ষতি হয় না , বরং সুস্থ ভাবে বাঁচা যায় , আর কিছুটা হলেও বিশ্ব উষ্ণায়ন রোধে নিজেকে সামিল করা যায় -এই ভাবনাই এখন কলকাতা জুড়ে ছড়িয়ে দিচ্ছেন ভেগানরা৷ সে অভিযানে শুধু ফেসবুক বা টুইটারকে হাতিয়ার করেই থেমে থাকেননি তাঁরা , রাস্তায় নেমে শুরু হয়েছে প্রচার অভিযান৷ সেই অভিযানেরই অন্যতম কান্ডারি নন্দিতা দাসের কথা ধরা যাক৷
যাদবপুরের ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ছাত্রী নন্দিতা বাড়িতে খরগোশ পুষতে ভালোবাসতেন৷ পোষ্য নিয়ে পড়াশোনা করতে করতেই ২০১৫ -তে ভেগানিজম সম্পর্কে জানা৷ আর তার পর এক বছরের মাথায় পুরোপুরি ভেগান হয়ে ওঠা৷ নন্দিতার গল্প জানার আগে একটু বুঝে নেওয়া যাক ভেগানিজম আদতে কী ?বিষয়টা জলবত্ তরলং করে বুঝিয়ে দিলেন ষাটোর্ধ্ব সুব্রত ঘোষ৷ পেশায় স্থপতি সুব্রত কয়েক মাস হল ভেগান হয়েছেন৷ বললেন , ‘স্পেসিজম বিষয়টা থেকেই ভেগানিজমের জন্ম৷ আমরা ছাগল , গোরু , মুরগি , ভেড়া এদের মাংস খাই , আর কুকুর -বিড়াল এদের আদর করে বাড়িতে পুষি৷ কিন্ত্ত এই বিভাজন কেন ? আসলে আমরা নিজেদের থেকে কম বুদ্ধিমান প্রাণীদের নিজেদের পছন্দমতো আলাদা আলাদা ভাবে ব্যবহার করছি৷
আর যাদের আমরা খাওয়ার জন্য বেছে নিচ্ছি , তাদের কেন্দ্র করে গড়ে উঠছে বড়সড় শিল্প ---বাণিজ্যিক পশুপালন৷ খামারে অপরিচ্ছন্ন , অপর্যান্ত স্থানে ঠেসাঠেসি করে রাখা হচ্ছে অসংখ্য মুরগি , গোরু , ছাগল বা শুয়োরকে৷ দুধের জোগান নিরবচ্ছিন্ন রাখতে গোরুদের কার্যত ধর্ষণ করানো হচ্ছে৷ ডিমের লোভে একই পরিণতি হচ্ছে মুরগিদের৷ মাংসের আশায় হরমোন ইঞ্জেকশন দিয়ে মুরগি বা শুয়োরকে এতটাই ফুলিয়ে -ফাঁপিয়ে তোলা হচ্ছে , নিজেদের পায়ে ঠিকমতো দাঁড়াতে পারে না বেচারারা৷ আমরা এটা ভেবে দেখি না , মানুষের থেকে বুদ্ধিমান প্রাণী যদি থাকত , আর তারা যদি মানুষকে এ ভাবে খাওয়ার জন্য পালন করত ?’এক কথায় বলতে গেলে , পশুপালন শিল্পের এই অমানবিকতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ থেকেই পশুজাত কিছু ব্যবহার না করার সিদ্ধান্ত৷ কিন্ত্ত বিশ্ব উষ্ণায়ন ? সেটা তো ঠিক বোঝা গেল না৷ তারও জবাব মিলল৷
সাম্প্রতিক গবেষণা বলছে , বাণিজ্যিক পশুপালনে এক একটি খামার থেকে প্রায় ৩৭ % মিথেন নিগর্মন হয় , যা কার্বন ডাই অক্সাইডের থেকে ২০ গুণ বেশি বিশ্ব -উষ্ণায়ন ঘটায়৷ তা ছাড়া , গোচারণের জন্য মাইলের পর মাইল বনভূমি প্রতি বছর কাটা পড়ে৷ যার ফলে প্রতি বছর বাতাসে কার্বন নির্গমন বাড়ে ২৪০ কোটি টন ! সুব্রতদের আশা , বিশ্বের ৫০ শতাংশ মানুষ যদি ভেগানিজমের পথে হাঁটে , তাতেই ফ্যাক্টরি ফার্মিং অনেকটা কমবে , আর সেই সঙ্গে কমবে বিশ্ব উষ্ণায়ন৷
এই ভাবনা আর পাঁচ জনের মধ্যে ছড়িয়ে দিতেই ২০১৬ থেকে ভেগান আন্দোলন শুরু করেন নন্দিতা৷ একজন -দু’জন বন্ধু ছাড়া আর কাউকেই পাশে পাননি৷ তাতেও হার মানেননি৷ প্রতি রবিবার রাস্তায় ঘুরে ঘুরে লোকজনকে বোঝানোর কাজ চলত৷ কেউ পাত্তা দিত না , কেউ কেউ আবার বিরক্তি প্রকাশ করত৷ নন্দিতার কথায় , ‘একদিন একজন খুব মন দিয়ে কথা শোনার পর বললেন , মুরগির মাংস কিনতে যাচ্ছিলাম , কিন্ত্ত তোমার কথা শোনার পর মনে হল থাক৷ সেদিন যে কী আনন্দ হয়েছিল৷ মনে হয়েছিল আমি কিছুটা হলেও সফল৷ ’ শুধু কথা বলে নয় , ল্যাপটপে পশুহত্যার ভিডিয়ো দেখিয়েও সচেতনতা প্রসারের চেষ্টা করেন নন্দিতারা৷ কখনও বা চলে ছবি এঁকে বা স্লোগান লিখে সচেতনতা প্রসারের কাজ৷ কলকাতার ভেগানদের একত্রিত করতে ‘বেঙ্গল রিবেলস অ্যাসোসিয়েশন ভেগান এনথুজিয়াস্ট ’ (ব্রেভ ) নামে একটি ফেসবুক পেজ খুলেছেন নন্দিতারা৷ সেখানেও ভেগানিজম সম্পর্কে সচেতনতা প্রসার করেন তাঁরা৷
‘ব্রেভ’-এরই এক সদস্য সায়ন মুখোপাধ্যায়৷ বছর ছাব্বিশের সায়ন নৌসেনায় কর্মরত৷ পশুপ্রেম থাকলেও ভেগান সম্পর্কে খুব একটা ওয়াকিবহাল ছিলেন না৷ পশু সংরক্ষণ নিয়ে পড়াশোনা করতে গিয়েই ভেগানিজমের প্রতি আকৃষ্ট হন দর্শনশাস্ত্রের এই ছাত্র৷ বুঝতে পারেন , প্রাণিজ প্রোটিনের কোনও প্রয়োজন নেই৷ মধ্যবিত্তের ডাল -ভাত , ছোলাতেই রয়েছে পুষ্টির যথেষ্ট জোগান৷ তার পর থেকেই ভেগান হওয়ার সূত্রপাত৷ সায়নের কথায় , ‘সকলকে পুরোপুরি ভেগান হতে হবে না৷ কেউ যদি কোনও একটি দিন , বা নিদেন পক্ষে একবেলা ভেগান হওয়ায় চেষ্টা করে , তাতেই বাণিজ্যিক পশুপালন অনেকটা কমবে৷ চেন এফেক্টে কমবে বিশ্ব উষ্ণায়ন৷ ’ সায়নদের এই ডাকে সাড়াও মিলছে ভালোই৷ বাচ্চারা বিশেষ করে টিনএজারদের থেকে বেশি সাড়া পাচ্ছেন তাঁরা৷ সেই উত্সাহ হাতিয়ার করেই এক সুস্থ , সুন্দর পৃথিবী উপহার দিতে চান নন্দিতা , সায়ন , সুব্রতরা৷
ভেগান হয়েও এভারেস্ট জয়
প্রথম ভেগান হিসেবে ২০১৬ -তে এভারেস্ট জয় গুজরাটি পরিবারের ছেলে কুন্তল জৈশেরের৷ ১৫ বছর আগে আমেরিকায় পড়াশোনা করতে গিয়ে প্রথম ভেগানিজমের সঙ্গে পরিচয় তাঁর৷ বললেন , ‘শুধু পর্বতারোহণ নয় , যে কোনও কাজের ক্ষেত্রেই ফিটনেস খুব জরুরি৷ এভারেস্ট অভিযানের সময় বেসক্যাম্পে পাওভাজি , ভেগান কেক , পোহা , উপমা দিব্যি খেয়েছি৷ খাবার নিয়ে আমার কোনও সমস্যা কখনওই হয়নি৷ বরং ভেগান খাবার খেয়েই আমি সুস্থ ছিলাম৷ ’ কুন্তল নিজে কখনও অন্যকে ভেগান হতে উত্সাহিত করেননি , কিন্ত্ত তাঁর সুস্থতা ও উদ্যোগ দেখে পরিচিত অনেকেই ভেগানিজমে আগ্রহ দেখিয়েছেন৷ তাঁর স্ত্রীও এখন পুরোপুরি ভেগান৷ কুন্তলের সোজাসাপ্টা বক্তব্য , ‘রোজগারের মোটা অংশ চিকিত্সার জন্য খরচ করবেন , না স্বাস্থ্যকর খাবারে --- সে পছন্দ আপনার৷ আমার কাছে সুস্থ থাকাট খুব দরকার৷ ’ কলকাতাতেও ভেগানদের সংখ্যা ক্রমে বাড়ছে বলে আশাবাদী কুন্তল৷
ভেগান রেস্তোরাঁ, মিলবে বিরিয়ানিও
ভেগানদের কথা মাথায় রেখেই পথ চলা শুরু ‘মিয়াজ গ্রিলে ’র৷ কলকাতার একমাত্র ভেগান এই রেস্তোরাঁর কর্ণধার মিতালি বন্দ্যোপাধ্যায়৷ ভাইঝি জামাই ভেগান৷ তাঁর হাত ধরেই কলকাতার ভেগান দলের সঙ্গে আলাপ ষাটোর্ধ্ব মিতালির৷ ভেগানদের জন্য কলকাতায় কোনও রেস্তোরাঁ নেই , তাই তারা অনেক স্বাদ থেকেই বঞ্চিত --- এই ভাবনা থেকেই মিতালির কাজ শুরু৷ তাঁর প্রিন্স আনোয়ার শাহ রোডের রেস্তোরাঁয় ভেগান বিরিয়ানি থেকে শুরু করে চকলেট ম্যুজ, কাস্টার্ড সবই মেলে৷
বিন্যাস: অরিন্দম মজুমদার
শব্দটার সঙ্গে বছর কয়েক আগেও খুব একটা পরিচিত ছিল না কল্লোলিনী কলকাতা৷ ‘ভেজিটেরিয়ান ’ শব্দের প্রথম তিনটি ও শেষ দু’টি অক্ষর নিয়ে তৈরি ‘ভেগান ’, কিন্ত্ত তাঁদের পরিচিতি শুধু নিরামিশাষি নয়৷ খাবার, পোশাক বা বিনোদনের জন্য কোনও প্রাণীর ব্যবহার কোনও ভাবেই সমর্থন করেন না ভেগানরা৷ আর সেই কারণেই তাঁদের ডায়েট চার্ট থেকে বাদ মাছ , মাংস , ডিম থেকে শুরু করে ডেয়ারি দ্রব্য৷ পোশাকের তালিকা থেকে বাদ পশম বা সিল্ক৷ চিড়িয়াখানা , অ্যামিউজমেন্ট পার্ক বা সার্কাসে যান না তাঁরা৷ আমজনতার চোখে রীতিমতো কৃচ্ছ্রসাধন৷
কিন্ত্ত আমার -আপনার মতো মধ্যবিত্ত বাড়ির ছেলেমেয়েরাও সেই কৃচ্ছ্রসাধনের পথে এগোচ্ছে৷ কলকাতায় ভেগানের সংখ্যা এখন নেহাত কম নয়৷ আর তাঁদের অধিকাংশেরই বয়স ১৬ থেকে ৪০ -এর মধ্যে ! মাংস বা ডেয়ারি দ্রব্য না খেলে স্বাস্থ্যের কোনও ক্ষতি হয় না , বরং সুস্থ ভাবে বাঁচা যায় , আর কিছুটা হলেও বিশ্ব উষ্ণায়ন রোধে নিজেকে সামিল করা যায় -এই ভাবনাই এখন কলকাতা জুড়ে ছড়িয়ে দিচ্ছেন ভেগানরা৷ সে অভিযানে শুধু ফেসবুক বা টুইটারকে হাতিয়ার করেই থেমে থাকেননি তাঁরা , রাস্তায় নেমে শুরু হয়েছে প্রচার অভিযান৷ সেই অভিযানেরই অন্যতম কান্ডারি নন্দিতা দাসের কথা ধরা যাক৷
যাদবপুরের ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ছাত্রী নন্দিতা বাড়িতে খরগোশ পুষতে ভালোবাসতেন৷ পোষ্য নিয়ে পড়াশোনা করতে করতেই ২০১৫ -তে ভেগানিজম সম্পর্কে জানা৷ আর তার পর এক বছরের মাথায় পুরোপুরি ভেগান হয়ে ওঠা৷ নন্দিতার গল্প জানার আগে একটু বুঝে নেওয়া যাক ভেগানিজম আদতে কী ?বিষয়টা জলবত্ তরলং করে বুঝিয়ে দিলেন ষাটোর্ধ্ব সুব্রত ঘোষ৷ পেশায় স্থপতি সুব্রত কয়েক মাস হল ভেগান হয়েছেন৷ বললেন , ‘স্পেসিজম বিষয়টা থেকেই ভেগানিজমের জন্ম৷ আমরা ছাগল , গোরু , মুরগি , ভেড়া এদের মাংস খাই , আর কুকুর -বিড়াল এদের আদর করে বাড়িতে পুষি৷ কিন্ত্ত এই বিভাজন কেন ? আসলে আমরা নিজেদের থেকে কম বুদ্ধিমান প্রাণীদের নিজেদের পছন্দমতো আলাদা আলাদা ভাবে ব্যবহার করছি৷
আর যাদের আমরা খাওয়ার জন্য বেছে নিচ্ছি , তাদের কেন্দ্র করে গড়ে উঠছে বড়সড় শিল্প ---বাণিজ্যিক পশুপালন৷ খামারে অপরিচ্ছন্ন , অপর্যান্ত স্থানে ঠেসাঠেসি করে রাখা হচ্ছে অসংখ্য মুরগি , গোরু , ছাগল বা শুয়োরকে৷ দুধের জোগান নিরবচ্ছিন্ন রাখতে গোরুদের কার্যত ধর্ষণ করানো হচ্ছে৷ ডিমের লোভে একই পরিণতি হচ্ছে মুরগিদের৷ মাংসের আশায় হরমোন ইঞ্জেকশন দিয়ে মুরগি বা শুয়োরকে এতটাই ফুলিয়ে -ফাঁপিয়ে তোলা হচ্ছে , নিজেদের পায়ে ঠিকমতো দাঁড়াতে পারে না বেচারারা৷ আমরা এটা ভেবে দেখি না , মানুষের থেকে বুদ্ধিমান প্রাণী যদি থাকত , আর তারা যদি মানুষকে এ ভাবে খাওয়ার জন্য পালন করত ?’এক কথায় বলতে গেলে , পশুপালন শিল্পের এই অমানবিকতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ থেকেই পশুজাত কিছু ব্যবহার না করার সিদ্ধান্ত৷ কিন্ত্ত বিশ্ব উষ্ণায়ন ? সেটা তো ঠিক বোঝা গেল না৷ তারও জবাব মিলল৷
সাম্প্রতিক গবেষণা বলছে , বাণিজ্যিক পশুপালনে এক একটি খামার থেকে প্রায় ৩৭ % মিথেন নিগর্মন হয় , যা কার্বন ডাই অক্সাইডের থেকে ২০ গুণ বেশি বিশ্ব -উষ্ণায়ন ঘটায়৷ তা ছাড়া , গোচারণের জন্য মাইলের পর মাইল বনভূমি প্রতি বছর কাটা পড়ে৷ যার ফলে প্রতি বছর বাতাসে কার্বন নির্গমন বাড়ে ২৪০ কোটি টন ! সুব্রতদের আশা , বিশ্বের ৫০ শতাংশ মানুষ যদি ভেগানিজমের পথে হাঁটে , তাতেই ফ্যাক্টরি ফার্মিং অনেকটা কমবে , আর সেই সঙ্গে কমবে বিশ্ব উষ্ণায়ন৷
এই ভাবনা আর পাঁচ জনের মধ্যে ছড়িয়ে দিতেই ২০১৬ থেকে ভেগান আন্দোলন শুরু করেন নন্দিতা৷ একজন -দু’জন বন্ধু ছাড়া আর কাউকেই পাশে পাননি৷ তাতেও হার মানেননি৷ প্রতি রবিবার রাস্তায় ঘুরে ঘুরে লোকজনকে বোঝানোর কাজ চলত৷ কেউ পাত্তা দিত না , কেউ কেউ আবার বিরক্তি প্রকাশ করত৷ নন্দিতার কথায় , ‘একদিন একজন খুব মন দিয়ে কথা শোনার পর বললেন , মুরগির মাংস কিনতে যাচ্ছিলাম , কিন্ত্ত তোমার কথা শোনার পর মনে হল থাক৷ সেদিন যে কী আনন্দ হয়েছিল৷ মনে হয়েছিল আমি কিছুটা হলেও সফল৷ ’ শুধু কথা বলে নয় , ল্যাপটপে পশুহত্যার ভিডিয়ো দেখিয়েও সচেতনতা প্রসারের চেষ্টা করেন নন্দিতারা৷ কখনও বা চলে ছবি এঁকে বা স্লোগান লিখে সচেতনতা প্রসারের কাজ৷ কলকাতার ভেগানদের একত্রিত করতে ‘বেঙ্গল রিবেলস অ্যাসোসিয়েশন ভেগান এনথুজিয়াস্ট ’ (ব্রেভ ) নামে একটি ফেসবুক পেজ খুলেছেন নন্দিতারা৷ সেখানেও ভেগানিজম সম্পর্কে সচেতনতা প্রসার করেন তাঁরা৷
‘ব্রেভ’-এরই এক সদস্য সায়ন মুখোপাধ্যায়৷ বছর ছাব্বিশের সায়ন নৌসেনায় কর্মরত৷ পশুপ্রেম থাকলেও ভেগান সম্পর্কে খুব একটা ওয়াকিবহাল ছিলেন না৷ পশু সংরক্ষণ নিয়ে পড়াশোনা করতে গিয়েই ভেগানিজমের প্রতি আকৃষ্ট হন দর্শনশাস্ত্রের এই ছাত্র৷ বুঝতে পারেন , প্রাণিজ প্রোটিনের কোনও প্রয়োজন নেই৷ মধ্যবিত্তের ডাল -ভাত , ছোলাতেই রয়েছে পুষ্টির যথেষ্ট জোগান৷ তার পর থেকেই ভেগান হওয়ার সূত্রপাত৷ সায়নের কথায় , ‘সকলকে পুরোপুরি ভেগান হতে হবে না৷ কেউ যদি কোনও একটি দিন , বা নিদেন পক্ষে একবেলা ভেগান হওয়ায় চেষ্টা করে , তাতেই বাণিজ্যিক পশুপালন অনেকটা কমবে৷ চেন এফেক্টে কমবে বিশ্ব উষ্ণায়ন৷ ’ সায়নদের এই ডাকে সাড়াও মিলছে ভালোই৷ বাচ্চারা বিশেষ করে টিনএজারদের থেকে বেশি সাড়া পাচ্ছেন তাঁরা৷ সেই উত্সাহ হাতিয়ার করেই এক সুস্থ , সুন্দর পৃথিবী উপহার দিতে চান নন্দিতা , সায়ন , সুব্রতরা৷
ভেগান হয়েও এভারেস্ট জয়
প্রথম ভেগান হিসেবে ২০১৬ -তে এভারেস্ট জয় গুজরাটি পরিবারের ছেলে কুন্তল জৈশেরের৷ ১৫ বছর আগে আমেরিকায় পড়াশোনা করতে গিয়ে প্রথম ভেগানিজমের সঙ্গে পরিচয় তাঁর৷ বললেন , ‘শুধু পর্বতারোহণ নয় , যে কোনও কাজের ক্ষেত্রেই ফিটনেস খুব জরুরি৷ এভারেস্ট অভিযানের সময় বেসক্যাম্পে পাওভাজি , ভেগান কেক , পোহা , উপমা দিব্যি খেয়েছি৷ খাবার নিয়ে আমার কোনও সমস্যা কখনওই হয়নি৷ বরং ভেগান খাবার খেয়েই আমি সুস্থ ছিলাম৷ ’ কুন্তল নিজে কখনও অন্যকে ভেগান হতে উত্সাহিত করেননি , কিন্ত্ত তাঁর সুস্থতা ও উদ্যোগ দেখে পরিচিত অনেকেই ভেগানিজমে আগ্রহ দেখিয়েছেন৷ তাঁর স্ত্রীও এখন পুরোপুরি ভেগান৷ কুন্তলের সোজাসাপ্টা বক্তব্য , ‘রোজগারের মোটা অংশ চিকিত্সার জন্য খরচ করবেন , না স্বাস্থ্যকর খাবারে --- সে পছন্দ আপনার৷ আমার কাছে সুস্থ থাকাট খুব দরকার৷ ’ কলকাতাতেও ভেগানদের সংখ্যা ক্রমে বাড়ছে বলে আশাবাদী কুন্তল৷
ভেগান রেস্তোরাঁ, মিলবে বিরিয়ানিও
ভেগানদের কথা মাথায় রেখেই পথ চলা শুরু ‘মিয়াজ গ্রিলে ’র৷ কলকাতার একমাত্র ভেগান এই রেস্তোরাঁর কর্ণধার মিতালি বন্দ্যোপাধ্যায়৷ ভাইঝি জামাই ভেগান৷ তাঁর হাত ধরেই কলকাতার ভেগান দলের সঙ্গে আলাপ ষাটোর্ধ্ব মিতালির৷ ভেগানদের জন্য কলকাতায় কোনও রেস্তোরাঁ নেই , তাই তারা অনেক স্বাদ থেকেই বঞ্চিত --- এই ভাবনা থেকেই মিতালির কাজ শুরু৷ তাঁর প্রিন্স আনোয়ার শাহ রোডের রেস্তোরাঁয় ভেগান বিরিয়ানি থেকে শুরু করে চকলেট ম্যুজ, কাস্টার্ড সবই মেলে৷
বিন্যাস: অরিন্দম মজুমদার