অ্যাপশহর

ভালোবাসার সাতপাকে অ্যাসিড-দগ্ধ

আর একটা হাত অর্ধ যুগ শক্ত করে তাঁকে ধরে রেখেছে। সবসময় অভয় দিয়েছে, 'আমিই তোর ডান চোখ।' প্রতিজ্ঞা করেছে অ্যাসিড হামলায় এলোমেলো হয়ে যাওয়া জীবনটাকে গুছিয়ে রাখার। কাল, মঙ্গলবার তারই আর এক ধাপ, শর্তহীন ভালোবাসার সাতপাকে এক হতে চলেছে চার হাত। পাত্রের মা-বাবাই যে শুভ অনুষ্ঠানের নেপথ্যে।

EiSamay 24 Feb 2020, 7:56 am
কমলেশ চৌধুরী
EiSamay.Com রবিবার দমদমে
রবিবার দমদমে


একটা হাত ভালোবাসার দাবি নিয়ে তাঁর দিকে অ্যাসিড ছুড়ে মেরেছিল। ডান চোখ নষ্ট হয়েছে, মুখের দগদগে ঘা আজও শুকোয়নি। মনের তো দূর অস্ত্!

আর একটা হাত অর্ধ যুগ শক্ত করে তাঁকে ধরে রেখেছে। সবসময় অভয় দিয়েছে, 'আমিই তোর ডান চোখ।' প্রতিজ্ঞা করেছে অ্যাসিড হামলায় এলোমেলো হয়ে যাওয়া জীবনটাকে গুছিয়ে রাখার। কাল, মঙ্গলবার তারই আর এক ধাপ, শর্তহীন ভালোবাসার সাতপাকে এক হতে চলেছে চার হাত। পাত্রের মা-বাবাই যে শুভ অনুষ্ঠানের নেপথ্যে।

দমদমের সঞ্চয়িতা যাদবের জীবন এক লহমায় অন্ধকারে ডুবে গিয়েছিল ২০১৪ সালের ২২ সেপ্টেম্বর। সম্পর্ক থেকে বেরিয়ে আসার খেসারত, মুখে অ্যাসিড ছুড়েছিল প্রাক্তন প্রেমিক। ঝড়-জলের সেই রাতে সঞ্চয়িতার সবচেয়ে বড় সহায় হয়ে উঠেছিল দমদমের তরুণ শুভ্র দে। মাসকয়েক আগেই আলাপ। সঞ্চয়িতাকে ভালো লাগত শুভ্রর, বলেওছিলেন সে কথা। জবাব পাননি। তবু ফোন পেয়ে অপেক্ষা করেননি শুভ্র। ছুটে গিয়েছিলেন আরজি কর হাসপাতালে। সেই শুরু। তার পর যখনই প্রয়োজন হয়েছে, পাশে থেকেছেন, সাহস জুগিয়েছেন। অটোয় চেপে হাসপাতালে আসা-যাওয়ায় অনেক খরচ। দু'জনে দুটো সাইকেলে যেতেন। গাড়ি-ভর্তি রাস্তায় শুভ্র বলতেন, 'চিন্তা নেই, আমি আছি তো। আমিই তোর ডান চোখ।' মঙ্গলবার তাঁদের শুভদৃষ্টি।

বিয়ে যে এখনই হচ্ছে, তাতে বড় ভূমিকা রয়েছে শুভ্রর মা-বাবার। রবিবার বিকেলে দমদমের কাঠগোলায় শুভ্রর বাড়িতে মেহেন্দি পরছিলেন হবু শাশুড়ি-বৌমা। সঞ্চয়িতা বলেন, 'টেলিভিশনে একটি অনুষ্ঠানে আমি গিয়েছিলাম। শুভ্রও যায়। সেই অনুষ্ঠান দেখেই ওঁরা আমাদের সম্পর্কের কথা জানতে পারেন। আমার বাবা অনেকদিন নেই, গত বছর মা-ও মারা যায়। একদিন শুভ্রর মা বাড়িতে ডেকে আমার সঙ্গে কথা বলেন। তার পর বিয়ে ঠিক হয়। ওঁরাই সব দায়িত্ব নিয়েছেন। কেনাকাটা, আয়োজন- সব।'

তবে অ্যাসিডে ক্ষতবিক্ষত একটা মেয়েকে বৌমা করে ঘরে তুলবেন, এটা প্রথমেই মানতে পারেননি শুভ্রর মা রীতা। বলেন, 'আমার একমাত্র ছেলে। এ ভাবে তো ভাবিনি আগে। তাই মানতে সমস্যা হয়েছিল। পরে ভাবলাম, এই বয়সেই মেয়েটার উপর এত ঝড় যাচ্ছে! মা-ও মারা গেল। একা একা কত লড়াই করবে? আর ছেলে যখন ওর পাশে থাকতে চায়, তাই সিদ্ধান্ত নিই, ওদের বিয়ে দেব।' পাশে দাঁড়িয়ে শুভ্রর বাবা প্রবীর বলেন, 'ও নিজের লড়াই করেও যে ভাবে অন্য অ্যাসিড আক্রান্তদের পাশে দাঁড়ায়, আমি সবসময় বাহবা দিই। ভালোবাসা মন থেকে হয়, তাই ছেলে যা চেয়েছে, মেনে নিয়েছি। বিয়ের পর এমন কিছু ঘটলে কি ফেলে দিতে পারতাম?' কাছের মানুষের ভালোবাসায় আপ্লুত সঞ্চয়িতা। বলেন, 'ওকে অনেক বুঝিয়েছিলাম, রাখিস না সম্পর্ক। কিন্তু কখনও আমাকে ঠেলে ফেলে দেয়নি।'

২০১৫ সালে এ ভাবেই এক ইঞ্জিনিয়ারের সঙ্গে সাতপাকে বাঁধা পড়েছিলেন ধানবাদের অ্যাসিড-যোদ্ধা সোনালি মুখোপাধ্যায়। পরের বছর লখনৌয়ের অ্যাসিড আক্রান্ত সাবিনা নতুন জীবন শুরু করেন পড়শি মহম্মদ সামসাদের সঙ্গে। জয়নগরের অ্যাসিড আক্রান্ত তরুণী মনীষা পৈলান সঞ্চয়িতার অভিন্নহৃদয় বন্ধু। বিয়ের খবরে খুব খুশি তিনি। বলেন, 'প্রেমের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করলে দুটো কারণে অ্যাসিড ছোড়ে। এক, অন্য কেউও যাতে বিয়ে করতে না-পারে। দুই, জীবন স্তব্ধ করে দিতে। সঞ্চয়িতা চাকরি করছে, বিয়েও হচ্ছে। এটা একটা বড় থাপ্পড়।'

হাইকোর্টে লড়াই করে অভিযুক্তকে জেলে ঢুকিয়েছেন সঞ্চয়িতা। কিন্তু এখনও শাস্তি হয়নি। কবে মামলা উঠবে, তার আশায় দিন গোনেন। তিন লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ হিসেবে পেয়েছেন, কিন্তু চিকিৎসায় যা খরচ তাতে সে টাকা সামান্যই। ডান চোখে পাথর বসেছে, পাঁচ বার অপারেশন হয়েছে বাঁ চোখে। নাকে দু'বার। আজও পুরোনো ছবি, এখনকার ছবি মেলানো যায় না। কোনও দিন যাবেও না। সঞ্চয়িতা তবু শান্তি পাবেন অভিযুক্তর শাস্তি হলে। হবু বৌমার আইনি লড়াইয়েও সামিল শ্বশুরবাড়ি। শুভ্রর বাবা বলেন, 'আমরা সবসময় আছি। আমরা শুধু চাই, এই ধরনের জঘন্য অপরাধে যেন কঠিনতম শাস্তি হয়। না-হলে ওর মতো অনেক জীবন নষ্ট হয়ে যাবে।'

সব অ্যাসিড-দগ্ধ সঞ্চয়িতার পাশে একজন শুভ্র থাকবেন, আর বলবেন, 'প্রতিজ্ঞা করেছি, ওকে কোনওদিন ছাড়ব না,' এমন রূপকথা তো বারবার লেখা হয় না!

পরের খবর

West bengal newsসম্পর্কে আরও বিস্তারিত ও নতুন খবর জানতে ক্লিক করুন। সব ধরনের ব্রেকিং, আপডেট এবং বিশ্লেষণ সবার প্রথম বাংলায় পড়তে ক্লিক করুন Bengali Newsএই সময় ডিজিটাল