অ্যাপশহর

বামুনের ঘরে যবনের ঠাঁই! ধর্মযুদ্ধ সুভাষের

নুন আনতে পান্তা ফুরানোর পাঁচ জনের সংসারে আরও তিনটে পেট কী করে চলবে তা না ভেবে, গত ৭ মাস ধরে দুই সন্তান-সহ সখিনাকে আশ্রয় দিয়েছেন তিনি। নিজের মেয়ের মতোই তাঁকে আগলে রেখেছেন রায়চৌধুরী দম্পতি।

EiSamay 14 Jul 2019, 11:20 am
শীর্ষেন্দু গোস্বামী, বহরমপুর
EiSamay.Com fight against intolerance west bengal baharampur
গত ৭ মাস ধরে দুই সন্তান-সহ সখিনাকে আশ্রয় দিয়েছেন রায়চৌধুরী দম্পতি।


যজমানের ঘরে যবনের ঠাঁই হওয়ায় ঢিঢি পড়ে গিয়েছিল গোটা গ্রামে। 'জাত গেল, জাত গেল' বলে রাস্তায়, পুকুর পাড়ে শুরু হয় মেয়ে-বৌদের আলোচনা। নারায়ণ পুজো, লক্ষ্মী পুজো এমনকী শ্রাদ্ধ অনুষ্ঠানে ডাকা বন্ধ করে দেন অনেকে। সংসারে আর্থিক টান পড়লেও হার মানেননি হরিহরপাড়ার সুভাষ রায়চৌধুরী। নুন আনতে পান্তা ফুরানোর পাঁচ জনের সংসারে আরও তিনটে পেট কী করে চলবে তা না ভেবে, গত ৭ মাস ধরে দুই সন্তান-সহ সখিনাকে আশ্রয় দিয়েছেন তিনি। নিজের মেয়ের মতোই তাঁকে আগলে রেখেছেন রায়চৌধুরী দম্পতি।

দেশজুড়ে অসহিষ্ণুতার মধ্যে এই উদাহরণ খোলা বাতাসের মতো বলে মনে করেন হরিহরপাড়ার বিডিও পূর্ণেন্দু সান্যাল। তিনি বলেন, 'ওই রায়চৌধুরী পরিবার যা করেছেন, তা ভাবা যায় না। বর্তমান সময়ে ভিন জাতের একটি মেয়েকে সন্তান-সহ আশ্রয় দেওয়াটা মুখের কথা নয়। বিশেষ করে পাড়াপড়শিদের টিপ্পনী-বদনাম শোনা সত্ত্বেও। সরকারি ভাবে যা সাহায্য করা উচিত আমরা তা করব।' পুরোহিত সুভাষ রায়চৌধুরী বলেন, 'সখিনা আমার দ্বিতীয় মেয়ে। পুজো করে আমার সাংসার চলে। বেশ কিছু বাড়িতে আমাকে এখন আর পুজো করতে ডাকে না। তাতে হয়তো একটু অসুবিধা হয়। কিন্তু নিজের মনের কাছে এটা আমার বড় জয়।'

সখিনা বলেন, 'হিন্দু পরিবারে এইভাবে একটি মুসলিম পরিবারের মেয়েকে আশ্রয় দেওয়া নিয়ে কাকুর উপর অনেক ঝড়ঝাপটা গেছে। আমি নিজের চোখে দেখে তা সহ্য করতে পারিনি। ভেবেছিলাম বাড়ি ছেড়ে চলে যাব। কিন্তু কাকু বলেছে, তুই আমার আর একটা মেয়ে। খবরদার যাবি না কোথাও। ওঁদের কথায় মায়া রয়েছে। ভালোবাসা রয়েছে। তাই আর পালাতে পারিনি।'

গত ডিসেম্বর মাসে বাপের বাড়ি থেকে টাকা আনার জন্য সখিনার উপর চাপ সৃষ্টি করেছিল হরিহরপাড়ার চোঁয়া গ্রামের পেশায় রাজমিস্ত্রি নুর ইসলাম সর্দার। জলঙ্গির বাসিন্দা সখিনার সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়ছিল বছর ১৩ আগে। তাঁদের বছর দশেকের ছেলে ও এক বছরের একটি মেয়ে রয়েছে। টাকা আনতে অস্বীকার করায় সখিনাকে বেধড়ক মারধর করে বাড়ি থেকে বের করে দেয় নুর। সখিনা বলেন, 'টাকা আনব কী করে? বছর দুয়েক আগে বাবা ও মা দুজনেই মারা গেছেন। দাদারা টাকা দেবে না। কী করব? তাই বাধ্য হয়ে রাস্তায় এক কাপড়ে দুই সন্তানকে নিয়ে পথকেই আশ্রয় করে বসেছিলাম। আর নিজের কপালকে দোষারোপ করছিলাম। সেই সময় রাস্তা দিয়ে পুজো করে ফিরছিলেন পুরোহিত কাকু। সকাল থেকে অনেকে দেখলেও তাদের মতো মুখ ঘুরিয়ে চলে যেতে পারেননি তিনি। ঘটনা শোনার পর দুই সন্তান-সহ আমাকে নিয়ে আসেন নিজের ঘরে। সেই একচিলতে ঘরে ছেলে ও মেয়ের সঙ্গে আমারও জায়গা মেলে।'

আশপাশের দু'তিনটি গ্রামে পুজো করে কোনওরকমে সংসার চলে রায়চৌধুরী পরিবারের। ভাগ্যের বিড়ম্বনায় তাঁদের একমাত্র মেয়ে কাকলিও স্বামীর অত্যাচারে শ্বশুরবাড়ি ছেড়ে বাপের বাড়িতে রয়েছেন অনেক দিন ধরে। হিন্দু পরিবারে এইভাবে একটি মুসলিম পরিবারের মেয়েকে আশ্রয় দেওয়া নিয়ে অনেক ঝড়ঝাপটা এসেছে। অনেকেই সুভাষকে বাদ দিয়ে অন্য গ্রাম থেকে পুরোহিত ডেকে এনে পুজো করানো শুরু করেন। তারা না-ডাকলেও দমে যাননি সুভাষ। নিজের মেয়ের মতো করেই গত ৭ মাস ধরে এক ছাদের তলায় রেখেছেন সখিনা ও তাঁর দুই সন্তানকে।

সুভাষের স্ত্রী ইলা বলেন, 'ছোট ছোট দুটো সন্তানকে নিয়ে যখন ও বাড়িতে এল তখন ভেবেছিলাম এ বার কী হবে। ওকে বলেছি আমরা যে ভাবে থাকব, ওকেও সেভাবে নিজের মেয়ের মতো সুন্দর করে রাখব। শুধু একটু ঘর থাকলে ভালো হত। ও আমার নিজের মেয়ের মতোই রয়েছে। সমাজ থেকে বাধা এসেছিল, কিন্তু তারা আমার খুব একটা ক্ষতি করতে পারেনি।' মেয়ে কাকলি বলেন, 'সখিনাকে নিজের বোনের মতো ভাবি। যে দিন ও রাস্তায় বসে সন্তানদের নিয়ে কান্নাকাটি করছিল, সেই দিনটার মর্মকথা আমিও বুঝি। আমার স্বামীও আমাকে তাড়িয়ে দিয়েছিল। তাই বাবা যখন ওকে নিয়ে এল, তখন মনে হল উপযুক্ত কাজ করেছে। আমাদের একটু ভাত জুটলে ওঁর ও জুটবে।'

পরের খবর

West bengal newsসম্পর্কে আরও বিস্তারিত ও নতুন খবর জানতে ক্লিক করুন। সব ধরনের ব্রেকিং, আপডেট এবং বিশ্লেষণ সবার প্রথম বাংলায় পড়তে ক্লিক করুন Bengali Newsএই সময় ডিজিটাল