অ্যাপশহর

হারানো নদীপথের খোঁজে

লোককথা , মুখে মুখে চলে আসা গল্প থেকে ইতিহাস অনুন্ধানের পাশাপাশি অত্যাধুনিক পদ্ধতিতে তিন হাজার বছর আগের নদীর অবস্থান নির্ণয়ের চেষ্টা চলছে চন্দ্রকেতুগড়ে৷

EiSamay 10 Dec 2017, 11:24 am
লোককথা , মুখে মুখে চলে আসা গল্প থেকে ইতিহাস অনুন্ধানের পাশাপাশি অত্যাধুনিক পদ্ধতিতে তিন হাজার বছর আগের নদীর অবস্থান নির্ণয়ের চেষ্টা চলছে চন্দ্রকেতুগড়ে৷ গল্প , ইতিহাস আর বিজ্ঞানের যোগসূত্র খুঁজলেন সুমিত্র বন্দ্যোপাধ্যায়
EiSamay.Com chandraketugarh is trying to determine the location of the river
হারানো নদীপথের খোঁজে


আগডুম বাগডুম ঘোড়াডুম সাজেখোল মৃদঙ্গ ঝাঁঝর বাজে …এমনও তো হতে পারে , আগে (সামনে ) ডোম , বাগে (পাশে ) ডোম , ঘোড়া ডোম সাজে … মানে যুদ্ধের বর্ণনা৷ ডোম হল সেই বাঙালি যোদ্ধা , যার ভয়ে পঞ্চনদ জয় করেও এ পারে আসেননি ম্যাসিডনিয়ার রাজা আলেকজান্ডার ? দেখা যাক ইতিহাস কী বলে৷

রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর বাঙ্গালার ইতিহাসে লিখছেন , ‘নাগপূজক কয়েকটি জাতি বাঙ্গালা হইতে এবং ভারতের উত্তরাঞ্চল হইতে তামিলকম্ দেশে যায়৷ ইহাদের মধ্যে মরণ , চের ও পাঙ্গালাথির -ইয়র উল্লেখ্য৷ চেরগণ উত্তর পশ্চিমপাঙ্গালা হইতে দক্ষিণ ভারতে যায়৷ সেখানে গিয়ে তাহারা চেররাজ্য স্থাপন করে৷ পাঙ্গালা যে বাঙ্গালা , তাহা নিঃসন্দেহে বলতে পারা যায় …’ মরণরাই কি ডোম ? হতেও পারে৷ সে যাই হোক , এখানে একটি বিষয় স্পষ্ট , সভ্যতা পূর্ব থেকেও পশ্চিম ও দক্ষিণে গিয়েছিল৷ সিন্ধু অববাহিকা থেকে সভ্যতা ছড়িয়েছে , এমন ধারণা সর্বাংশে ঠিক নাও হতে পারে৷ গঙ্গারিডিতে শুধু স্বতন্ত্র সভ্যতাই ছিল না , এই রাজ্য ছিল বেশ শক্তিশালী৷ রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় লিখছেন , ‘মাসিডনরাজ দিগ্বিজয়ী আলেকজাণ্ডার বা সেকেন্দর , পঞ্চনদ অধিকার করিয়া বিপাশা -তীরে উপস্থিত হইয়াছিলেন৷ বিপাশাতীরে , শিবিরে , তিনি আর্য্যাবর্তের পূর্বপ্রান্তে অবস্থিত ‘প্রাসিই ’ এবং ‘গঙ্গরিডই ’ নামক দুইটি পরাক্রান্ত রাজ্যের অস্তিত্বের কথা অবগত হইয়াছিলেন৷ ’ রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় অবশ্য চন্দ্রগুন্ত মৌর্যকে মগধের রাজা বলেই উল্লেখ করেছেন৷

১৯০৭ সালে চন্দ্রকেতুগড়ের সম্বন্ধে খোঁজখবর শুরুর অনেক আগে ১৮৭১ সালে প্রকাশিত ভারতীয় পুরাতত্ত্ব সর্বেক্ষণের নির্দেশক স্যর আলেকজান্ডার কানিংহ্যাম ‘দি এনসিয়েন্ট জিওগ্রাফি অফ ইন্ডিয়া ’য় লিখেছেন , সমতটের অবস্থান ছিল তাম্রলিন্তি বা তমলুক থেকে ১৫০ মাইল পূর্বে৷ পরে তিনি লিখছেন , ‘মুরালি বা যশোর খুব সম্ভবত টলেমি উল্লেখিত গঙ্গা রেজিয়া৷ ’ অর্থাত্ ক্লদিয়াস টলেমি (১০০ -১৬৮ খ্রিস্টাব্দ ) তাঁর বর্ণনায় এই জায়গার কথা উল্লেখ করেছেন৷

টলেমির বর্ণনার সঙ্গে গঙ্গারিডির অনেকাংশে মিল পাওয়া যায় বলে জানাচ্ছেন আইআইটি খড্গ়পুরের অধ্যাপক জয় সেন৷ বিজ্ঞান ও ঐতিহ্য সংক্রান্ত কেন্দ্রীয় সরকারের সন্ধি প্রকল্পে চন্দ্রকেতুগড়ের জিও হাইড্রোলজিক্যাল বিষয়ে গবেষণার দায়িত্ব রয়েছেন আইআইটি খড্গ়পুরের জিওলজি অ্যান্ড জিওফিজিক্স বিভাগের অধ্যাপক অরিন্দম বসু৷ তিনি বলেন , ‘উপগ্রহের সাহায্য নিয়ে রিমোট সেন্সরিংয়ের মাধ্যমে প্যালিও চ্যানেল ডিস্ট্রিবিউশন (জলের ধারা কেমন ছিল ) কী ভাবে চিহ্নিত করা যায় , সেই পদ্ধতি প্রস্তাব করেছি এবং এখানে কী ভাবে কাজ করা সম্ভব , সেই প্রয়োগ -পদ্ধতি উদ্ভাবন করেছি৷ ’ এই প্রকল্পে জিও -আর্কিওলজির দায়িত্বে রয়েছেন অধ্যাপক জয় সেন৷

অধ্যাপক সেন বলেন , ‘টলেমির কথা ধরে নিয়ে যদি মেনে নিই যে গঙ্গারিডির রাজধানী চন্দ্রকেতুগড় ছিল না , তা হলেও আমরা মনে করছি , চন্দ্রকেতুগড় অবশ্যই বন্দর -শহর ছিল এবং এর পশ্চাদভূমি শুধুমাত্র বৃহত্তর নদিয়ায় নয় , তা বিস্তৃত ছিল অবিভক্ত বাংলা তো বটেই , তা ছাড়িয়ে আরও দূর পর্যন্ত৷

দক্ষিণপূর্ব এশিয়া ও পারস্য উপসাগরের বৃহত্তর অঞ্চল , এমনকি জুলিয়াস সিজার ও প্লেটোর হাজার বছর আগেও ফোয়েনিশিয়া থেকে এই বন্দরে জাহাজ ভিড়ত৷ তাদের সঙ্গে ভাষাগত ও সাংস্কৃতিক আদানপ্রদানও হত৷ গ্রিসের সঙ্গেও এই অঞ্চলের সমুদ্রপথে যোগাযোগ ছিল৷ মৈথিলি -অর্ধ মগধি -ব্রাহ্মীর সঙ্গে খরোষ্ঠী এবং পশ্চিম এশিয়ার আরামায়িক ভাষার আদানপ্রদান ছিল৷ ’ ভূমধ্য সাগরের পূর্বপ্রান্তের এলাকাকে বলা হত ফোয়েনিশিয়া৷ এই জায়গায় বর্তমানে রয়েছে লেবানন , ইজরায়েল , সিরিয়া এবং তুরস্কের একাংশ৷ আর প্রাচীন গ্রিসও তখন আয়তনে আধুনিক গ্রিসের চেয়ে অনেক বড় অঞ্চল জুড়ে বিস্তৃত ছিল , যার বেশিরভাগ অংশই ছিল এশিয়া মহাদেশে৷ এই বন্দর থেকে তখন রন্তানি হত ছাপার জন্য দরকারি নীল ও লাল রং৷ এই নীল রন্তানি হত ব্রিটিশ আমলেও৷

অধ্যাপক সেন বলেন , ‘পূর্বভারতের অঙ্গ -কলিঙ্গ -প্রাগজ্যোতিষ অঞ্চলে যে সমৃদ্ধ সভ্যতা ছিল , মেগাস্থিনিস ও কার্ডিয়ার হায়রোনিমাস , এই দু’জনের লেখা ইন্ডিকা গ্রন্থ, বিবলিওথেকা হিস্টোরিয়ার সন্তদশ খণ্ড এবং ডায়ডোরাসের লেখায় সেই উল্লেখ রয়েছে৷ হিমালয় থেকে নেমে আসা দুই দীর্ঘ নদী গঙ্গা ও ব্রহ্মপুত্রের অববাহিকায় যে বিশ্বের সবচেয়ে বড় নদীমাতৃক সভ্যতার বিকাশ ঘটেছিল , সে কথা অ্যাপোলোনিয়াসের আর্গোনটিকা (খৃস্টপূর্ব তৃতীয় শতক ), ডায়নোসিয়াস পেরিগেটসের (খ্রিস্টিয় দ্বিতীয় ও তৃতীয় শতক ) রচনায় উল্লেখ রয়েছে৷ মেঘনা ও যমুনার অধিষ্ঠাত্রী হলেন মনসা ও সরস্বতী৷ আর দেবী সরস্বতী যে পদ্মাসনা , পদ্মা নাম তারই ইঙ্গিতবাহী৷ এই বিশাল অববাহিকার পশ্চিমদিকে একটি বন্দরনগরী হল চন্দ্রকেতুগড়৷ রাজা চন্দ্রকেতুর নামে এই গড়৷ মনসামঙ্গলে উল্লেখিত চাঁদ সদাগর ছিলেন এই চন্দ্রকেতুর পরম মিত্র৷ ’ চন্দ্রকেতুগড়ের সভ্যতা ও মনসামঙ্গলের লেখার সময়ের মাঝে অন্তত দেড় হাজার বছরের পার্থক্য রয়েছে৷ তবে মূর্তির ব্যাখ্যা (আইকনোগ্রাফি ) ও লোককথা ও মঙ্গলকাব্য ভিত্তিক নৃতত্ববিদ্যা বিশ্লেষণ করে এই সব লোককথার উত্সে পৌঁছানোর চেষ্টা করছেন আইআইটি খড্গ়পুরের অধ্যাপকরা৷ এই বিশাল ব -দ্বীপের পশ্চিমে ছিল ভাগীরথী বা আদিগঙ্গা , যা ভাগ হয়েছে রাজমহল পাহাড়ের কাছে , সাহেবগঞ্জে৷ আরেকটি ধারা ছিল , যার নাম ছিল দেগঙ্গা৷ গঙ্গার এই ব -দ্বীপ অঞ্চল বিস্তৃত রয়েছে এপার বাংলার নদিয়া , দুই চব্বিশ পরগনা ও কলকাতা থেকে বাংলাদেশের যশোহর -রাজশাহী -পাবনা পর্যন্ত৷ বিস্তীর্ণ এই অঞ্চলের বিভিন্ন শহরের মধ্যে নদীপথে উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা ছিল৷ দুই বাংলার বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে থাকা এই অঞ্চলের সভ্যতার ইতিহাস অন্তত তিন হাজার বছরের পুরোনো৷ গঙ্গা -যমুনা -সরস্বতীর ধারার মাঝেই গড়ে উঠেছিল আদিসন্তগ্রাম -ত্রিবেণী৷ চন্দ্রকেতুগড়ে ভিড়ত রোম ও গ্রিসের জাহাজ , আগে তারা নোঙর করত আরেকামেড়ু (অধুনা পুদুচেরি ) এবং তাম্রলিন্ততে৷ সেকালে চন্দ্রকেতুগড় ছিল বড় এক বাণিজ্যবন্দর৷ নামে বাণিজ্যবন্দর হলেও এই বন্দরই ছিল সংস্কৃতি আদানপ্রদানের প্রধান জায়গাও৷

কার্যত অনাবিস্কৃত ও অবহেলিত অঞ্চলের ইতিহাস অনুসন্ধান করে নতুন তথ্য হাতে আসায় উজ্জীবিত আইআইটি খড্গ়পুরের সংশ্লিষ্ট অধ্যাপকমণ্ডলী৷ তাঁদের প্যালিও চ্যানেল ডিস্ট্রিবিউশন সংক্রান্ত রিপোর্ট অতিসম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে পুরাতত্ত্ব ও নৃতত্ত্ববিজ্ঞান সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক স্প্রিঞ্জার জার্নালে , তার নাম ‘আর্কিয়োলজিক্যাল অ্যান্ড অ্যানথ্রোপলজিক্যাল সায়েন্সেস৷ ’কী ভাবে তিন হাজার বছর আগের নদীপথ খোঁজা হচ্ছে , সে কথা স্প্রিঞ্জার পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে৷ তাঁরা ফাজি ইনফারেন্স পদ্ধতিতে (এফআইএস ) এই কাজ করছেন৷ এই পদ্ধতি প্রয়োগ করে চন্দ্রকেতুগড়ের ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্য আবিষ্কার করার চেষ্টা করছেন বিজ্ঞানীরা৷ এ জন্য উপগ্রহ -চিত্রের সহায়তা নেওয়া হচ্ছে৷ তারপরে সেই চিত্র বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে বিশ্লেষণ করা হচ্ছে৷ তার পরে তার ব্যাখ্যা করা হচ্ছে৷ বোঝার চেষ্টা করা হচ্ছে যখন গঙ্গারিডি সভ্যতা বিকশিত হয় ও প্রসারিত হতে থাকে , তখন এই অঞ্চলে নদীগুলির অবস্থান কী ছিল৷

পরের খবর

West bengal newsসম্পর্কে আরও বিস্তারিত ও নতুন খবর জানতে ক্লিক করুন। সব ধরনের ব্রেকিং, আপডেট এবং বিশ্লেষণ সবার প্রথম বাংলায় পড়তে ক্লিক করুন Bengali Newsএই সময় ডিজিটাল