অ্যাপশহর

এইডসের ফাঁস ছিঁড়ে জোড়ার জীবনে বিয়ের ফুল

কতটা পথ পেরোলে তবে শরীরী বাধা, মারণরোগের ফাঁস দূরে ঠেলে দেওয়া যায় ? জানা নেই৷

EiSamay.Com 5 Dec 2016, 9:19 am
অতনু দাস ■ বারাসত
EiSamay.Com
এইডসের ফাঁস ছিঁড়ে জোড়ার জীবনে বিয়ের ফুল


‘শরীর শরীর, তোমার মন নাই কুসুম?’ কোনও দিন কি বাংলা উপন্যাসের এই কালজয়ী লাইন তুলে প্রেয়সীকে প্রশ্ন করেছিলেন উত্তর ২৪ পরগনার গোপালনগরের সাহসী তরুণ? জানা নেই৷

কতটা পথ পেরোলে তবে শরীরী বাধা, মারণরোগের ফাঁস দূরে ঠেলে দেওয়া যায় ? জানা নেই৷

শুধু জানা আছে আপাত অসম্ভব কাহিনিটা৷ যে কাহিনি রক্তমাংসের ঘেরাটোপ টপকে , সমাজের সব রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে মনের দেওয়া -নেওয়াকে পরিণতির দিকে ছুটিয়ে নিয়ে যাওয়ার৷ সাবিত্রী -সত্যবান (নাম পরিবর্তিত ) যার নায়ক -নায়িকা৷ থুড়ি , হবু বর -বধূ৷ কোথায় অন্য রকম গোপালনগরের তরুণ , হাসনাবাদের তরুণীর এই প্রেমকাব্য ? দু’জনের শরীরেরই যে বাসা বেঁধে আছে এইডসের জীবাণু৷ বছর চারেক আগে বিয়ে পাকা হয় সত্যবানের৷ কিন্ত্ত তাঁর রক্ত পরীক্ষায় দেখা যায় , এইচআইভি পজিটিভ৷ পিছিয়ে যান বছর ছত্রিশের তরুণ৷ হাসনাবাদের সাবিত্রী অবশ্য আগেও সংসার পেতেছিলেন৷ গরিব বাবা -মাকে কিছু না জানিয়ে এক দালাল তাঁর বিয়ে ঠিক করেছিল এইডস আক্রান্ত যুবকের সঙ্গে৷ কয়েক মাসের মধ্যেই মারা যান স্বামী৷ চুরমার হয়ে যায় তরুণীর সংসারের স্বপ্ন৷ উল্টে মারণরোগটির জীবাণু মৃত স্বামী দিয়ে গেলেন স্ত্রীর দেহে৷ দুর্বিষহ সময়ের সেই শুরু৷ ছোঁয়াছুঁয়ি বন্ধ , একঘরে হয়ে থাকার রোজনামচা৷
জেলার দুই প্রান্তের এই দুই তরুণ -তরুণীর মাঝে ফের বসন্তের আবির্ভাব বছর দুয়েক আগে৷

বারাসতে জেলার সংগঠন ‘এইচআইভি নেটওয়ার্ক’-এর দন্তরে দেখা -আলাপ৷ নিঃশব্দ চরণে প্রেমও আসে তাঁদের জীবনে৷ অবাধ্য এইচআইভি যে বাসা বেঁধে দৌড়োচ্ছে দু’জনেরই ধমনীতে , তা জেনেই হূদয় বিনিময়৷ শেষে কিছু দিন আগে সব ‘পাহাড় ’ ডিঙিয়ে তাঁরা তাঁদের ইচ্ছার কথা জানান নেটওয়ার্ককে৷ সম্মতি দেয় তারাও৷ তবে পয়সাকড়ির অভাব ও সমাজ দেওয়াল তুলে দাঁড়িয়ে থাকায় চার হাত এক হতে পারছিল না৷ মাসখানেক আগে এগিয়ে আসে হাবরার স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা ‘বাণীপুর ষষ্ঠমুখী জন সহায়ক কেন্দ্র ’৷ তাদের চেষ্টায় ৯ ডিসেম্বর , শুক্রবার যুগলের সংসার-স্বপ্ন সফল হচ্ছে৷ দক্ষ রাজমিস্ত্রি সত্যবান কাজের খোঁজে মুম্বই পাড়ি দিয়েছিলেন বছর পনেরো আগে৷ এক সময় ফিরে আসেন গোপালনগরে৷ তত দিনে পরিবার তাঁর বিয়ের সম্বন্ধ করে ফেলেছেন স্থানীয় এক তরুণীর সঙ্গে৷ শরীরে এইডসের জীবাণু মেলায় মনে মনে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছিলেন সত্যবান৷ বাধ্য হয়ে সরকারি চিকিত্সার আওতায় আসেন তিনি৷ সত্যবানের বক্তব্য , ‘আমি তখনই বাড়ির লোকজনকে বলেছিলাম , ‘কোনও মেয়ের জীবন আমি নষ্ট করতে চাই না৷ যদি কোনও দিন এইআইভি পজিটিভ কোনও মহিলা বিয়ে করতে চান , তা হলেই বিয়ে সম্ভব৷ তবে সমাজ কি মানবে সেই বিয়ে ? আর পাঁচটা দম্পতির মতো আমরা সংসার করতে পারব কি ? সেই দোলাচলও ছিল৷ ’

উত্তর ২৪ পরগনা জেলা ‘এইচআইভি নেটওয়ার্ক’-এর সহ -সভানেত্রী শুক্লা চক্রবর্তীর দাবি , ‘এই জেলায় আরও আড়াই হাজার এইচআইভি আক্রান্ত আছেন , যাঁরা লোকলজ্জার ভয়ে এখনও সরকারি চিকিত্সার আওতায় আসেননি৷ কেন , সেটা বোঝা যায় এই দুই তরুণ -তরুণীর জীবন কাহিনি জানলেও৷ পরিসংখ্যান জানাচ্ছে , গত এক বছরে সমস্যার কথা গোপন করে জেলায় অন্তত পাঁচটি বিয়ে হয়েছে৷ যাঁদের মধ্যে এক জন করে এইচআইভি পজিটিভ৷ ’ শুক্রবার হাবরারই বাণীপুরের একটি হোমে ফুটছে এই বিয়ের ফুল৷ জেলাশাসক , পুলিস সুপার , স্বাস্থ্য দন্তরের মুখ্য আধিকারিক -সহ আমন্ত্রিতের সংখ্যা দুশোরও বেশি৷ স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাটির কর্ণধার ইন্দ্রজিত্ পোদ্দার বলছেন , ‘এইচআইভি পজিটিভরা যে অচ্ছুত নয় , সেটা সমাজকে জানিয়ে সচেতনতা তৈরির জন্যই এই উদ্যোগ৷ ’ চিকিত্সকরাও বলছেন , স্বাভাবিক যৌনজীবন যাপনে কোনও অসুবিধা নেই এমন দম্পতির৷ এমনকি , সন্তানকামনায় বাধা হয়ে দাঁড়ানোরও কথা নয় এইচআইভি -র৷ বিশেষজ্ঞদের বক্তব্য , স্বামী কিংবা স্ত্রী অথবা উভয়ে যদি এইচআইভি পজিটিভ হয়েও থাকেন , তা হলেও সংক্রমণমুক্ত সুস্থ নবজাতক ভূমিষ্ঠ হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে ষোলো আনা৷ তবে হ্যাঁ, প্রয়োজন টানা চিকিত্সা এবং নিরন্তর চিকিত্সকের নজরদারি৷ এইচআইভি চিকিত্সায় রাজ্যের শীর্ষ প্রতিষ্ঠান ক্যালকাটা স্কুল অফ ট্রপিক্যাল মেডিসিন হাসপাতালের ট্রপিক্যাল মেডিসিন বিভাগের প্রধান বিভূতি সাহার কথায় , ‘প্রসূতি যদি ঠিকঠাক এআরটি (অ্যান্টি রিট্রোভাইরাল থেরাপি ) চিকিত্সায় থাকেন , তা হলে গর্ভস্থ ভ্রূণে সংক্রমণ ছড়ানোর আশঙ্কা কম৷ তা-ও ঝুঁকি না -নিয়ে নবজাতককে ১২ সন্তাহ পর্যন্ত নেভিরাপিন ওষুধ দেওয়া হয়৷ এর পরেও অবশ্য মা থেকে সন্তানের শরীরে সংক্রমণ ছড়ানোর আশঙ্কা থাকে , কিন্ত্ত তা ১ শতাংশেরও কম৷ ’

তিনি মনে করিয়ে দিয়েছেন , সন্তানধারণের আগে চিকিত্সকের সঙ্গে দম্পতির পরামর্শ করে নেওয়াটা জরুরি৷ ‘সিডি -ফোর পরীক্ষা করিয়ে মহিলার অনাক্রম্যতা দেখে নেওয়ার পাশাপাশি তাঁর রক্তে এইচআইভি -র ভাইরাল লোড -ও দেখে নেওয়া দরকার৷ যখন ভাইরাল লোড প্রায় শূন্য এবং অনাক্রম্যতা বেশি থাকে , তখনই সন্তানধারণের সেরা সময় ,’ মন্তব্য বিভূতির৷ সত্যবানই বলছিলেন , ‘দেখি না , আমরা কোথায় পৌঁছই , মরতে হলে আমরা একসঙ্গেই মরব৷ ’ এটা চিররহস্যে ঢাকা মনেরই তো গপ্পো !
West bengal newsসম্পর্কে আরও বিস্তারিত ও নতুন খবর জানতে ক্লিক করুন। সব ধরনের ব্রেকিং, আপডেট এবং বিশ্লেষণ সবার প্রথম বাংলায় পড়তে ক্লিক করুন Bengali Newsএই সময় ডিজিটাল