চিৎপুরের প্রাচীন চিত্র
জঙ্গলে ভরা গাঁ-গঞ্জ হলে কী হবে, সেখানে যে জাগ্রত দেবীর বাস। দেবী চিত্তেশ্বরী এবং কালীঘাটের মা কালী। আম বাঙালি তথা হিন্দুরা এই দুই দেবীর দর্শনে আসতেন অনেক কষ্ট সহ্য করে। আর দেবী চিত্তেশ্বরীর মন্দির যাওয়ার পথের নামই চিৎপুর। দেবী দর্শন করে সেখান থেকেই কালীঘাটের উদ্দেশ্যে রওনা দিতেন তীর্থযাত্রীরা। তখনও কলকাতা শহরের গোড়াপত্তন হয়নি। কিন্তু চিৎপুর তার আগেই ছিল। হালিশহর থেকে শুরু হয়ে আঁকাবাঁকা কাঁচা যে পথ পূর্ববঙ্গের যশোরের দিকে চলে গিয়েছে সেটিই ছিল চিৎপুর রোড। সেকালে সাধারণ মানুষের কাছে তীর্থক্ষেত্রে যাওয়ার রাস্তা। আর এখন এর নাম রবীন্দ্র সরণি। দাবি করা হয় যে, এই পথ তৈরি করেছিল সাবর্ণ রায়চৌধুরী পরিবার। প্রাচীন মনসামঙ্গল কাব্য এবং চণ্ডীমঙ্গল কাব্যে চিৎপুরের উল্লেখ আছে। এদিকে দেবীর নামে রাস্তা হলেও লোকে বলে দেবীর নামকরণ নাকি হয়েছিল দুর্ধর্ষ চিতে ডাকাতের নামে। সেখানে পুজো দিয়েই তাঁর দল নাকি ডাকাতিতে যেত। চিত্তেশ্বরী মন্দিরে নরবলির কথা সেই যুগে মুখে মুখে প্রচলিত ছিল। কালীঘাটে তীর্থ করতে যাওয়ার পথে ডাকাতের হাতে প্রাণ দেওয়ার ঘটনা অনেক ঘটেছে। সঙ্গে ছিল বাঘ সহ অন্যান্য বন্যপ্রাণীর উপদ্রব। এমনকি ব্রিটিশ আমলেও সেখানে লোকজন যেতে ভয় পেতেন। সেকারণে ব্রিটিশ আমলেও এই এলাকা এড়িয়ে কুমোরটুলি, জোড়াসাঁকো, কলুটোলা, বৌবাজার এলাকায় জনবসতি গড়ে উঠেছিল। সিপাহী বিদ্রোহের পরে নবাব ওয়াজিদ আলি শাহের পৃষ্ঠ পোষকতায় এই এলাকার একটা বড় অংশ সমৃদ্ধ হয়। এই স্থানকেই এখন আমরা বলি যাত্রাপাড়া।
চৌরঙ্গী
নামের সঠিক ইতিহাস নিয়ে গবেষকদের মধ্যে মত বিরোধ রয়েছে। তবুও মধ্য কলকাতার অন্যতম প্রাণকেন্দ্র চৌরঙ্গীর নামকরণ নিয়ে প্রচলিত কিংবদন্তিটিই সবচেয়ে জনপ্রিয়। কিংবদন্তি অনুসারে, চৌরঙ্গী গিরি নামে এক সন্ন্যাসীর নামানুসারে এই অঞ্চলের নামকরণ হয়। এই এই সন্ন্যাসীই নাকি মা কালীর স্বপ্নাদেশে আদি কালীঘাট মন্দিরটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। সপ্তদশ শতাব্দী পর্যন্ত ময়দান, ধর্মতলা ইত্যাদি এলাকা ছিল ঘন জঙ্গলপূর্ণ। সেখানে ডাকাত এবং বাঘের ভয়। কালীঘাট যাওয়ার জন্য বড়িশা থেকে হালিশহর পর্যন্ত একটি কাঁচা রাস্তা নির্মাণ করেছিলেন সাবর্ণ রায়চৌধুরী বংশের জমিদাররা। বর্তমানে এই রাস্তাটিই চিৎপুর রোড নামে পরিচিত। সেই রাস্তারই একধারে ছিল পুকুর, জলাভূমি, বাঁশঝাড় ও ধানক্ষেত। তার মধ্যে এখানে ওখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল জেলে, পাখির বাজিকর, কাঠুরিয়া এবং তাঁতিদের কুড়ে ঘর। তাঁদের ঘর নিয়ে যে তিনটি গ্রাম গড়ে উঠেছিল সেগুলি গল চৌরঙ্গী, বিরজি এবং কোলিম্বা। গোবিন্দপুর গ্রামের তুলনায় চৌরঙ্গী ছিল নিছকই হেলাফেলা একটি গাঁ। দুই গ্রামের মাঝে ছিল এক বিশাল জঙ্গল। আজকের ময়দানের দক্ষিণ-পূর্ব কোণ, ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল হল এবং রবীন্দ্রসদন এলাকার নাম একত্রে ছিল বিরজি গ্রাম। পলাশির যুদ্ধে পর নতুন ফোর্ট উইলিয়ম তৈরির সময় থেকেই কলকাতার ইউরোপীয় অধিবাসীরা সংলগ্ন স্থান ছেড়ে ময়দানের বাইরে এসে বসতি স্থাপন করতে শুরু করে। অষ্টাদশ শতাব্দীর মধ্যভাগে তৎকালীন চৌরঙ্গী গ্রামেই অট্টালিকা নির্মাণ শুরু করে দেন ইংরেজরা। কাঁচা থেকে পাকা হয় চিৎপুর রোড। এটিই কলকাতার প্রথম পাকা রাস্তা। ১৮৫৭ সালের ওরিয়েন্টাল গ্যাস কোম্পানির দ্বারা প্রথম গ্যাসের আলোয় সজ্জিত হয় চৌরঙ্গীর রাস্তা। ১৮৫৮ সালে চৌরঙ্গীতেই প্রথম ফুটপাথ নির্মাণ শুরু হয়। সেই ব্রিটিশ আমল থেকে শুরু করে আজও বিখ্যাত চৌরঙ্গী কলকাতাবাসীর নয়নের মণি। ভারত স্বাধীন হওয়ার পর চৌরঙ্গী রোডের নামকরণ হয় ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরুর নামানুসারে। অবশ্য লোকমুখে এলাকাটি আজও চৌরঙ্গী নামেই খ্যাত।
জঙ্গলগড়েই ময়দান
টেনিদার গড়ের মাঠে গোরা পেটানোর গল্প তো সকলেই জানে। কিন্তু তিনশো বছর আগেও সেখানে যে ঘন জঙ্গল ছিল তা জানেন কয় জন। আজ আমরা যাকে ময়দান বা গড়ের মাঠ বলি সেটি ছিল সেকালের গোবিন্দপুরের অংশ। এক কোণে ছোট্টো জীর্ণ গ্রাম থাকলেও গোটা ময়দান জুড়ে ছিল ঘন বন। বাঘ, শিয়াল, সাপ, বাঁদর আর ডাকাতদের আস্তানা ছিল এই জঙ্গল। জঙ্গলে পা রাখার কথা ইংরেজ বা বাঙালি কেউই ভাবতে পারতেন না। যদিও গঙ্গার ধারের এই স্থানে একটি দুর্গ তৈরির কথা চিন্তাভাবনা করতে শুরু করেছিল ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। দুর্গ তৈরির উদ্দেশ্যে ১৬৯৩ খ্রিস্টাব্দে পছন্দসই জায়গায় মাটির দেওয়ালে ঘিরে দেওয়ার নির্দেশ দেন স্যার জন গোল্ডসবরো। তখন মোঘল আমল। সম্রাটের অনুমতি না নিয়েই দুর্গ তৈরির সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন তিনি। আর তা নিয়েই মোঘল এবং ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির মধ্যে মনোমালিন্য শুরু হয়। ১৭০০ সালে দুর্গ তৈরির কাজ শেষ হয়। তৎকালীন ব্রিটিশ সম্রাট তৃতীয় উইলিয়মের নামে দুর্গের নামকরণ হয় ফোর্ট উইলিয়াম। পরবর্তী সময়ে এই দুর্গই হয়ে ওঠে ব্রিটিশদের প্রধান ঘাঁটি। এই দুর্গ আক্রমণের পরিকল্পনা করেছিলেন নবাব সিরাজউদ্দৌলা। ১৭৫৬ সালের ১৬ জুন প্রায় ৩০ হাজার সৈন্য বাহিনী নিয়ে সিরাজ হাজির হন কলকাতার উপকণ্ঠে। ১৮ জুন লালদিঘির যুদ্ধে ব্রিটিশদের পরাজিত করে ফোর্ট উইলিয়ম দখল করে নেন নবাব। কলকাতার নাম পরিবর্তন করে হয় আলিনগর। সিরাজের সঙ্গে ব্রিটিশদের যুদ্ধ হয়েছিল বর্তমানের রাইটার্স বিল্ডিং এবং লালবাজারের মাঝখানে। ফোর্ট উইলিয়ম দখল করে তাতে আগুন লাগিয়ে দেন সিরাজ। ভয়াবহ পরিণতির পর ইংরেজরা কিছুদিন থেমে থাকেন। পলাশীর যুদ্ধে সিরাজকে পরাজিত করার পর ফের ফোর্ট উইলিয়ম প্রতিষ্ঠা করেন। তবে এবার আর গড়ের মাঠে নয় দুর্গ নির্মিত হয় বর্তমানে ফোর্ট উইলিয়মের স্থানে। গড়ের মাঠের সমস্য গাছ কেটে ফেলা হয়। সংলগ্ন গ্রামের বাসিন্দাদের তালতলা, কুমারটুলি, শোভাবাজারের মতো এলাকায় জমি দেওয়া হয়। কিন্তু লোকমুখে মাঠের নাম আর পরিবর্তন হয়নি। গড় তৈরি হয়েছিল যে মাঠে তার নাম থেকে গেল গড়ের মাঠ। পরবর্তীকালে অবশ্য গড়ের মাঠের নাম পরিবর্তিত হযে হয় কলকাতা ময়দান। শহরের অন্যতম প্রাণকেন্দ্রকে ঘিরে গড়ে উঠেছে ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল, রাজভবন, ইডেন গার্ডেন, ভারতীয় জাদুঘর, বিড়লা প্ল্যানেটোরিয়াম, নেতাজি ইন্ডোর স্টেডিয়াম, শহিদ মিনার, আকাশবাণী ভবন।
গোরস্থানে সাবধান!
চিৎপুর যেমন ছিল তীর্থক্ষেত্র যাওয়ার রাস্তা তেমনই পার্ক স্ট্রিট ছিল গোরস্থান যাওয়ার পথ। তীর্থক্ষেত্রের রাস্তায় ছিল ডাকাত আর বাঘের ভয় এবং গোরস্থানে ছিল সাহেব ভূতের ভয়। সন্ধ্যা বা রাত তো বটেই দিনের বেলাতেও সেই স্থান দিয়ে যেতে সাহস করতেন না কেউ। বিশেষ করে বাঙালি হিন্দুরা ও পথে ভুলেও পা দিতেন না। কলকাতার জল-আবহাওয়ার সঙ্গে মানিয়ে নিতে না পারায় প্রথম প্রথম ইংরেজদের অসুস্থতা এবং মৃত্যুর হার ছিল ব্যাপক। নিজেদের তাগিদেই কলকাতায় খ্রিস্টান গোরস্থান তৈরি করেন তাঁরা। সেগুলির মধ্যেই অন্যতম পার্ক স্ট্রিট গোরস্থান। তার আগে অবশ্য একাধিক খ্রিস্টান কবরস্থান কলকাতা এবং সংলগ্ন এলাকায় প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে। কিন্তু মৃত্যুহার বাড়ায় সেগুলি ভরে যেতে থাকে। সেকারণেই ১৭৬৭ খ্রিস্টাব্দে তৎকালীন মারাঠা খালের কাছে নতুন সমাধিক্ষেত্র শুরুর কাজ শুরু হয়। সেই গোরস্থান সংলগ্ন এলাকায় প্রচুর বাদামগাছ থাকায় তার নাম ছিল বাদামতলা। গোরস্থানের কাছেই ছিল বাংলার গভর্নর হেনরি ভ্যান্সিটার্টের বাসভবন। পরে সেই ভবনে বাস করতেন সুপ্রিমকোর্টের প্রথম প্রধান বিচারপতি এলাইজা ইম্পে। তাঁর সেই বাসভবনের বাগানে ঘুরে বেড়াত পোষা হরিণ। লোকমুখে সেই স্থানের নাম হয়ে ওঠে ডিয়ার পার্ক, পরে সেটার নামই হয় পার্ক স্ট্রিট। লোরেটো হাউজ স্কুলও প্রাথমিকভাবে এই বাড়িতেই শুরু হয়েছিল। ক্রমে পার্ক স্ট্রিটই হয়ে ওঠে সাবেকি সাহেব পাড়া। ততদিনে ভূত এবং ডাকাতের ভয় দূর হয়ে গেছে। পার্ক স্ট্রিটের কাছেই ছিল একটি বড় দিঘি। তার মালিক ছিলেন ধর্ম নামে এক অবাঙালি ব্যবসায়ী। জনগণের জন্য সেই দিঘি বা তালাওটি তিনি দান করেছিলেন। কালক্রমে সেই স্থানটিই ধর্মতলা নামে পরিচিত। যদিও সেই গল্পেও অনেক দীর্ঘ। সেদিনের ভুতুরে গোরস্থানের রাস্তা আজকের জমকালো পার্ক স্ট্রিট। বড়দিনের সময় যে পার্ক স্ট্রিটের রূপের টানে সেখানে ভিড় জমান হাজার হাজার মানুষ। কে বলবে এই সেদিনও লোকের ভূতের ভয়ে এখানে আসতেন না। তবে ঝাঁ চকচকে পার্ক স্ট্রিটের সেই গোরস্থান কিন্তু আজও আছে। সমাধি দেওয়া না হলেও সেখানে ইতিহাসের গন্ধ পেতে অনেক কৌতূহলী মানুষ ঘুরে যান।
বো ব্যারাকস্
হেয়ার স্ট্রিট থেকে বউবাজার থানার মাঝামঝি রাস্তা। সরু রাস্তার দুই পাশে দাঁড়িয়ে কয়েকটি লাল ইঁটের প্রকাণ্ড অট্টালিকা। পোশাকী নাম যাই হোক না কেন সকলের কাছে এই স্থানটি বো ব্যারাকস্ নামেই পরিচিত। প্রায় একশো বছর ধরে এই ঘুপচি গলিকে যেন পাহারা দিচ্ছে লাল বাড়িগুলি। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় সেনাবাহিনীর বসবাসের জন্যে নাকি এই বাড়িগুলি তৈরি হযেছিল। পরে ব্রিটিশরা দেশ ছেড়ে চলে গেলে বাড়িগুলি খালি হয়ে যায়। আর তারপর থেকেই সেখানে থাকতে শুরু করেন কলকাতা শহরের অ্যাংলো বাসিন্দা বা 'কালো চামড়ার সাহেব-মেম'-রা। শহরের সাহেবি-সংস্কৃতির একমাত্র জীবিত উত্তরসূরি এঁরা। বলা হয় সেই বাড়িগুলির নাকি কোনও লিখিত দলিল নেই। তবুও, এই না সাহেব, না বাঙালি এমন মানুষের দল আজও সেই পাড়ায় নিজেদের শিকড় আঁকড়ে পড়ে আছেন। সরকারের তরফে পুনর্বাসনের বিনিময়ে বাড়ির ছাড়ার প্রস্তাবে রাজি হননি কেউই। সত্যি বলতে কি বড়দিন আর নিউ ইয়ার ছাড়া বো ব্যারাকের কথা কারও মনে পড়ে না। তবে কলকাতার টুকরো টুকরো ইতিহাস জানতে চাইলে এই এলাকা পায়ে হেঁটে ঘুরে এলাকাবাসীর সঙ্গে আলাপ জমাতে পারেন। এমন সব ঘটনার কথা হয়তো জানতে পারবেন যা কল্পনাও করতে পারেননি।