বিশ্বকর্মা পুজোর আগে সে কারণটাই খুঁজতে বেরিয়েছিলেন মহুয়া দত্তমিত্র
পেটকাটি চাঁদিয়াল, মোমবাতি বগ্গা/ আকাশে ঘুড়ি ঝাঁক, মাটিতে অবজ্ঞা/ বয়স ১২ কি ১৩, রিক্সা চালাচ্ছে/ আকাশে ঘুড়ির ঝাঁক ছেলেটাকে ডাকছে…..
না, এখন আর ১২-১৩ বছরের সব ছেলেদের আকাশের ঘুড়ির ঝাঁক ডাকে না৷ বরং ডাকে মোবাইল গেম৷ ডাকে ফেসবুক, ইন্সটাগ্রাম৷ এখন আর স্বাধীনতা দিবস কিংবা বিশ্বকর্মা পুজোর দিন বাড়ির ছাদে ছাদে ভোঁ-কাট্টা বলে ঘুড়ি ওড়ানোর প্রতিযোগিতা হয় না৷ কার কটা ঘুড়ি কাটা হল তা গোনাও হয় না৷ স্কুলে গিয়ে আলোচনা হয় না ‘এই কাল ক’টা ঘুড়ি কাটলি রে’ বলে৷ অথচ বছর কয়েক আগেও স্বাধীনতা দিবস থেকে বিশ্বকর্মা পুজোর দিন পর্যন্ত আকাশে দেখা মিলত ঘুড়ির ঝাঁকের৷ কেন এমনটা হয়ে গেল? যেখানে বিভিন্ন মোবাইল অ্যাপস লাখ টাকায় ঘুড়ি বিক্রি করছে, সেখানে আকাশে ঘুড়ির ঝাঁকের অভাব কেন?
ঘুড়ি কেন কম উড়ছে
মধ্য কলকাতার অন্যতম ঘুড়ি বিক্রেতা লেবুতলা বাগানের ইন্ডিয়ান কাইট দোকানের বর্তমান মালিক অজিত দত্তর মতে, ‘সময় দিদি সময়৷ এখন বাচ্চাদের ঘুড়ি ওড়ানোর সময় কোথায়? ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলগুলোর তো সারা বছরই পরীক্ষা গেলে থাকে৷ পড়ার ফাঁকে সময় পাবে, তবে তো ঘুড়ি ওড়াবে?’ কিন্ত্ত এই পরীক্ষা তো আগেও ছিল৷ হঠাত্ করে তো শুরু হয়নি৷ তাহলে? বেসরকারি দপ্তরে চাকুরিরত দেবাশিস দত্ত-র যমজ সন্তান৷ ‘কাদের সঙ্গে ঘুড়ি ওড়াতে দেব? এখন কোন বাচ্চার মনে কী চলছে, সেটা বোঝা মুশকিল৷ দেখছেন না, বন্ধুরাই এখন শত্রু হতে দু’মিনিট সময় নিচ্ছে না৷ আমাদের সময় এমন ছিল না৷ তাই বাবা-মায়েরা নিশ্চিন্তে ছেড়ে দিত বাচ্চাদের বন্ধুদের সঙ্গে ঘুড়ি ওড়াতে বা অন্য খেলাধূলোর জন্য৷’ বলছেন দেবাশিসবাবু৷ আবার তাঁর স্ত্রী শিপ্রার মত অন্য৷ ‘আগে কেরিয়ার নিয়ে বাবা-মায়েরা খুব বেশি সচেতন ছিলেন না৷ এখন প্রতিযোগিতা বেড়ে গিয়েছে প্রবল৷ স্কুলের ক্লাস পরীক্ষার নম্বর ফাইনালে যোগ হয়৷ তাই প্রতিটি পরীক্ষাই সমান গুরুত্বের৷ সেখানে কোনওভাবে সমঝোতা করা যাবে না৷ তাই পড়াশোনার ক্ষতি করে ঘুড়ি বা অন্য কোনও ধরনের খেলাধূলো করার সময় নেই৷’ ডন বসকোর অষ্টম শ্রেণীর ছাত্র অর্ঘ্য দাস ঘুড়ি ওড়াতে ভালোবাসে৷ কিন্ত্ত ওড়াতে পারে না৷ ‘আমি ঘুড়ি ওড়াতে ভালোবাসি, কিন্ত্ত পারি না৷ কেউ সাহায্য করলে শিখিয়ে দিলে অন্তত পড়ার ফাঁকে একটা দিন চাই ঘুড়ি ওড়াতে,’ বলল অর্ঘ্য৷ কিন্ত্ত তার ব্যস্ত বাবা-দাদার সময় নেই তাকে শেখানোর৷
প্রতিযোগিতার ইঁদুর দৌঁড়ে কি হারিয়ে যাবে ঐতিহ্য? নাগেরবাজার চত্বরের অস্থায়ী ঘুড়ি ব্যবসায়ী সুরঞ্জন রায়ের মতে, ‘দেখুন পড়াশোনা বলুন, বা সোস্যাল মিডিয়া, এখনকার বাবা-মায়ের পাশাপাশি ছেলে-মেয়েরাও মাঠে-ময়দানে নেমে খেলার ইচ্ছে রাখে না৷ ঘুড়ি ওড়ানোর বদলে বিশ্বকর্মা পুজোর দিন রঙিন পানীয়তেই ইয়ং জেনারেশেনের আগ্রহ বেড়েছে৷ এখন তো কোনও অজুহাত দরকার৷ ব্যস দু’পাত্র গলায় ঢালো৷’ বিরক্তির সঙ্গে বললেন সুরঞ্জনবাবু৷
ব্যবসায়িক ক্ষতি
ঘুড়ি ওড়ানোর সময় নেই৷ ফলে বিক্রি কম৷ আগে সারা বছরই ঘুড়ি বিক্রি হত৷ এখন বিশ্বকর্মা পুজোর দিন-কয়েক আগেই মূলত ঘুড়ি বিক্রি হয়৷ মেটিয়াবুরুজের ‘মেহেমুদ কাইট’ দোকানের ঘুড়ি ব্যবসায়ী মেহেমুদ হুসেন জানালেন, ‘ঘুড়ির ব্যবসা খারাপ হয়ে যাচ্ছে৷ আগে সারা বছর যে বিপুল হারে ঘুড়ি বিক্রি হত, এখন তা অনেকটাই কমে গিয়েছে৷ একটা সময় ২০-২৫ হাজার কারিগর ছিল, এখন কমতে কমতে যা দাঁড়িয়েছে ৪-৫ হাজারে৷ সারা বছর কাজ না থাকায় তাই কারিগরদেরও অন্য কাজ দেখতে হচ্ছে৷’ ঘুড়ির দাম কি এর জন্য দায়ী? ‘দাম৷ আরে ৩ টাকা থেকে তো ঘুড়ির দাম শুরু হচ্ছে৷ ভালো ঘুড়ি ৭-৮ টাকার মধ্যেই পাওয়া যায়৷ আগে এই সিজনে ২ থেকে ৫ টাকায় পাওয়া যেত৷ তাহলে কী আর বেড়েছে? এর চেয়ে অনেক বেশি টাকা অন্য কত খাতে যে খরচা হয়!’ বললেন লেবুতলা বাগানের বেঙ্গল কাইট দোকানের মালিক বাবলু সেন৷ বিশ্বকর্মা ছাড়াও পৌষ সংক্রন্তি, সরস্বতী পুজো অক্ষয় তৃতীয়াতে আগে বিপুল পরিমাণ ঘুড়ি বিক্রি হত৷ এখন সরস্বতী পুজোয় কিছু হলেও, অন্যগুলোর ঐতিহ্য আর প্রায় নে-ই৷
প্রভাব মাঞ্জাতেও
ঘুড়ি আর মাঞ্জা ‘মেড ফর ইচ আদার’৷ একটা সময় পাড়ায় পাড়ায় দল বেঁধে রাত জেগে সুতোয় মাঞ্জা দেওয়ার ছিল রেওয়াজ৷ এখন সে-সবও উধাও৷ কারণ সেই ‘সময়’৷ সময়ের অভাবে মাঞ্জা দেওয়া সুতো কিনেই ঘুড়ি ওড়ায় এখনও কিছু উত্সাহী মানুষ৷ এক সময় কলকাতার আশে-পাশেই এই মাঞ্জা সুতো তৈরি হত৷ কিন্ত্ত এখন কারিগরের অভাব শুধু ঘুড়ি বানানোতেই নয়, সুতোতেও হয়েছে৷ এখানে ভালো মাঞ্জা দেওয়া সুতো তৈরির কারিগরের সংখ্যাও কমে গিয়েছে৷ তাই বারেলি থেকে সুতো আসে৷ আবার এখন সস্তায় পাওয়া যাচ্ছে চাইনিজ সুতো৷ সম্প্রতি যে সুতোয় বাঁধা উড়ন্ত ঘুড়ি একটি বাচ্চার মৃত্যুও ঘটিয়েছে দিল্লিতে৷ বহু জায়গাতে এই সুতো ব্যবহার নিষিদ্ধ করা হয়েছে৷ তবু কলকাতার বিভিন্ন ঘুড়ির দোকানে এই সুতো বিক্রি চলছে৷
মোদি-ঘুড়ি
প্লাস্টিক দূষণ নিয়ে বহু তর্ক-বিতর্ক৷ অথচ এই সব কিছুকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে রমরমিয়ে বাজারে পাওয়া যাচ্ছে প্লাস্টিকের ঘুড়ি৷ যার মূল্য মাত্র দেড় টাকা৷ রয়েছে প্লাস্টিকের রকেট ঘুড়িও৷ যার মূল্য পনেরো টাকা৷ হই হই করে বাজারে বিক্রি হচ্ছে৷ এই নিয়েও রয়েছে ক্ষোভ৷ ‘আমরা বিক্রেতা৷ ক্রেতার চাহিদা মতো জোগান তো দিতে হবে৷ অস্ট্রেলিয়ান কাগজে তৈরি প্রচলিত ঘুড়ির থেকে এই ধরনের প্লাস্টিকের ঘুড়ি অনেক বেশি টেকসই৷ বাচ্চাদের একটা কিনে দিলেই হল৷ কাগজের ঘুড়িতে তো তা হবে না৷ তাই লোকজন এই ধরনের ঘুড়ি চায়৷ এগুলোও কিন্ত্ত ক্ষতিকারক৷ কিন্ত্ত যেমন প্লাস্টিক ব্যাগও বন্ধ হয় না, এগুলোও হয় না৷ আসলে আমরাই তো খারাপ,’ শেষ কথাটা যেন নিজেকেই বলেই চুপ করে গেলেন ঘুড়ি ব্যবসায়ী বাবলুবাবু৷ এই প্লাস্টিকের ঘুড়িতে রয়েছেন দেশের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি-অভিনেত্রী সোনাক্ষী সিনহা থেকে ‘সুলতান’-‘রইস’-এর পোস্টার দেওয়া প্লাস্টিক ঘুড়ি৷ রয়েছে ছোটা ভীম-বার্বিও৷ চল্লিশ মাইক্রন প্লাস্টিক দিয়ে ঘুড়ি বানালে তা উড়বে না স্বাভাবিকভাবেই৷ তাই দূষণ তৈরি করা প্লাস্টিকেই তৈরি হচ্ছে ঘুড়ি, বিকোচ্ছেও৷ তবু আশা ঘুড়ি ওড়ানোর ইচ্ছার ঘাটতি, ঘুড়ি ব্যবসায় মন্দা কিংবা বেনিয়মের ঘুড়ি-মাঞ্জা সুতোর পরেও ঘুড়ি পাগল মানুষের জন্য আবারও দেখা যাবে আকাশে ঘুড়ির ঝাঁক, শোনা যাবে ভোঁ- কাট্টা….‘ওই নিয়ে আটটা’৷
অন্য সময়-এর মত
বিশ্বকর্মা পুজোয় ঘুড়ি ওড়ানো বাঙালির একটা ঐতিহ্য৷ বস্ত্তত দুর্গাপুজো সর্বজনীন থেকে বিশ্বজনীন হচ্ছে আর তার আগে-পরের পুজোগুলোর ঐতিহ্য যেন তত মিলিয়ে যাচ্ছে৷ বাঙালি শ্রমিক বিশ্বকর্মা পুজোয় আজও অনন্দ করেন, কিন্ত্ত গৃহস্থের বাড়ির ছাদে উঠে ছেসেছোকরাদের সারাদিন কাটানোটাও তো এ শহরের ঐতিহ্য৷ কেবল একটা দিন যদি ঐতিহ্যর পিছনে দেওয়া যায়, খারাপ কী? ঐতিহ্য নিয়ে বাড়াবাড়িও তো আজকের দিনে একটি বিশ্বজনীন প্রবণতা৷
পেটকাটি চাঁদিয়াল, মোমবাতি বগ্গা/ আকাশে ঘুড়ি ঝাঁক, মাটিতে অবজ্ঞা/ বয়স ১২ কি ১৩, রিক্সা চালাচ্ছে/ আকাশে ঘুড়ির ঝাঁক ছেলেটাকে ডাকছে…..
না, এখন আর ১২-১৩ বছরের সব ছেলেদের আকাশের ঘুড়ির ঝাঁক ডাকে না৷ বরং ডাকে মোবাইল গেম৷ ডাকে ফেসবুক, ইন্সটাগ্রাম৷ এখন আর স্বাধীনতা দিবস কিংবা বিশ্বকর্মা পুজোর দিন বাড়ির ছাদে ছাদে ভোঁ-কাট্টা বলে ঘুড়ি ওড়ানোর প্রতিযোগিতা হয় না৷ কার কটা ঘুড়ি কাটা হল তা গোনাও হয় না৷ স্কুলে গিয়ে আলোচনা হয় না ‘এই কাল ক’টা ঘুড়ি কাটলি রে’ বলে৷ অথচ বছর কয়েক আগেও স্বাধীনতা দিবস থেকে বিশ্বকর্মা পুজোর দিন পর্যন্ত আকাশে দেখা মিলত ঘুড়ির ঝাঁকের৷ কেন এমনটা হয়ে গেল? যেখানে বিভিন্ন মোবাইল অ্যাপস লাখ টাকায় ঘুড়ি বিক্রি করছে, সেখানে আকাশে ঘুড়ির ঝাঁকের অভাব কেন?
ঘুড়ি কেন কম উড়ছে
মধ্য কলকাতার অন্যতম ঘুড়ি বিক্রেতা লেবুতলা বাগানের ইন্ডিয়ান কাইট দোকানের বর্তমান মালিক অজিত দত্তর মতে, ‘সময় দিদি সময়৷ এখন বাচ্চাদের ঘুড়ি ওড়ানোর সময় কোথায়? ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলগুলোর তো সারা বছরই পরীক্ষা গেলে থাকে৷ পড়ার ফাঁকে সময় পাবে, তবে তো ঘুড়ি ওড়াবে?’ কিন্ত্ত এই পরীক্ষা তো আগেও ছিল৷ হঠাত্ করে তো শুরু হয়নি৷ তাহলে? বেসরকারি দপ্তরে চাকুরিরত দেবাশিস দত্ত-র যমজ সন্তান৷ ‘কাদের সঙ্গে ঘুড়ি ওড়াতে দেব? এখন কোন বাচ্চার মনে কী চলছে, সেটা বোঝা মুশকিল৷ দেখছেন না, বন্ধুরাই এখন শত্রু হতে দু’মিনিট সময় নিচ্ছে না৷ আমাদের সময় এমন ছিল না৷ তাই বাবা-মায়েরা নিশ্চিন্তে ছেড়ে দিত বাচ্চাদের বন্ধুদের সঙ্গে ঘুড়ি ওড়াতে বা অন্য খেলাধূলোর জন্য৷’ বলছেন দেবাশিসবাবু৷ আবার তাঁর স্ত্রী শিপ্রার মত অন্য৷ ‘আগে কেরিয়ার নিয়ে বাবা-মায়েরা খুব বেশি সচেতন ছিলেন না৷ এখন প্রতিযোগিতা বেড়ে গিয়েছে প্রবল৷ স্কুলের ক্লাস পরীক্ষার নম্বর ফাইনালে যোগ হয়৷ তাই প্রতিটি পরীক্ষাই সমান গুরুত্বের৷ সেখানে কোনওভাবে সমঝোতা করা যাবে না৷ তাই পড়াশোনার ক্ষতি করে ঘুড়ি বা অন্য কোনও ধরনের খেলাধূলো করার সময় নেই৷’ ডন বসকোর অষ্টম শ্রেণীর ছাত্র অর্ঘ্য দাস ঘুড়ি ওড়াতে ভালোবাসে৷ কিন্ত্ত ওড়াতে পারে না৷ ‘আমি ঘুড়ি ওড়াতে ভালোবাসি, কিন্ত্ত পারি না৷ কেউ সাহায্য করলে শিখিয়ে দিলে অন্তত পড়ার ফাঁকে একটা দিন চাই ঘুড়ি ওড়াতে,’ বলল অর্ঘ্য৷ কিন্ত্ত তার ব্যস্ত বাবা-দাদার সময় নেই তাকে শেখানোর৷
প্রতিযোগিতার ইঁদুর দৌঁড়ে কি হারিয়ে যাবে ঐতিহ্য? নাগেরবাজার চত্বরের অস্থায়ী ঘুড়ি ব্যবসায়ী সুরঞ্জন রায়ের মতে, ‘দেখুন পড়াশোনা বলুন, বা সোস্যাল মিডিয়া, এখনকার বাবা-মায়ের পাশাপাশি ছেলে-মেয়েরাও মাঠে-ময়দানে নেমে খেলার ইচ্ছে রাখে না৷ ঘুড়ি ওড়ানোর বদলে বিশ্বকর্মা পুজোর দিন রঙিন পানীয়তেই ইয়ং জেনারেশেনের আগ্রহ বেড়েছে৷ এখন তো কোনও অজুহাত দরকার৷ ব্যস দু’পাত্র গলায় ঢালো৷’ বিরক্তির সঙ্গে বললেন সুরঞ্জনবাবু৷
ব্যবসায়িক ক্ষতি
ঘুড়ি ওড়ানোর সময় নেই৷ ফলে বিক্রি কম৷ আগে সারা বছরই ঘুড়ি বিক্রি হত৷ এখন বিশ্বকর্মা পুজোর দিন-কয়েক আগেই মূলত ঘুড়ি বিক্রি হয়৷ মেটিয়াবুরুজের ‘মেহেমুদ কাইট’ দোকানের ঘুড়ি ব্যবসায়ী মেহেমুদ হুসেন জানালেন, ‘ঘুড়ির ব্যবসা খারাপ হয়ে যাচ্ছে৷ আগে সারা বছর যে বিপুল হারে ঘুড়ি বিক্রি হত, এখন তা অনেকটাই কমে গিয়েছে৷ একটা সময় ২০-২৫ হাজার কারিগর ছিল, এখন কমতে কমতে যা দাঁড়িয়েছে ৪-৫ হাজারে৷ সারা বছর কাজ না থাকায় তাই কারিগরদেরও অন্য কাজ দেখতে হচ্ছে৷’ ঘুড়ির দাম কি এর জন্য দায়ী? ‘দাম৷ আরে ৩ টাকা থেকে তো ঘুড়ির দাম শুরু হচ্ছে৷ ভালো ঘুড়ি ৭-৮ টাকার মধ্যেই পাওয়া যায়৷ আগে এই সিজনে ২ থেকে ৫ টাকায় পাওয়া যেত৷ তাহলে কী আর বেড়েছে? এর চেয়ে অনেক বেশি টাকা অন্য কত খাতে যে খরচা হয়!’ বললেন লেবুতলা বাগানের বেঙ্গল কাইট দোকানের মালিক বাবলু সেন৷ বিশ্বকর্মা ছাড়াও পৌষ সংক্রন্তি, সরস্বতী পুজো অক্ষয় তৃতীয়াতে আগে বিপুল পরিমাণ ঘুড়ি বিক্রি হত৷ এখন সরস্বতী পুজোয় কিছু হলেও, অন্যগুলোর ঐতিহ্য আর প্রায় নে-ই৷
প্রভাব মাঞ্জাতেও
ঘুড়ি আর মাঞ্জা ‘মেড ফর ইচ আদার’৷ একটা সময় পাড়ায় পাড়ায় দল বেঁধে রাত জেগে সুতোয় মাঞ্জা দেওয়ার ছিল রেওয়াজ৷ এখন সে-সবও উধাও৷ কারণ সেই ‘সময়’৷ সময়ের অভাবে মাঞ্জা দেওয়া সুতো কিনেই ঘুড়ি ওড়ায় এখনও কিছু উত্সাহী মানুষ৷ এক সময় কলকাতার আশে-পাশেই এই মাঞ্জা সুতো তৈরি হত৷ কিন্ত্ত এখন কারিগরের অভাব শুধু ঘুড়ি বানানোতেই নয়, সুতোতেও হয়েছে৷ এখানে ভালো মাঞ্জা দেওয়া সুতো তৈরির কারিগরের সংখ্যাও কমে গিয়েছে৷ তাই বারেলি থেকে সুতো আসে৷ আবার এখন সস্তায় পাওয়া যাচ্ছে চাইনিজ সুতো৷ সম্প্রতি যে সুতোয় বাঁধা উড়ন্ত ঘুড়ি একটি বাচ্চার মৃত্যুও ঘটিয়েছে দিল্লিতে৷ বহু জায়গাতে এই সুতো ব্যবহার নিষিদ্ধ করা হয়েছে৷ তবু কলকাতার বিভিন্ন ঘুড়ির দোকানে এই সুতো বিক্রি চলছে৷
মোদি-ঘুড়ি
প্লাস্টিক দূষণ নিয়ে বহু তর্ক-বিতর্ক৷ অথচ এই সব কিছুকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে রমরমিয়ে বাজারে পাওয়া যাচ্ছে প্লাস্টিকের ঘুড়ি৷ যার মূল্য মাত্র দেড় টাকা৷ রয়েছে প্লাস্টিকের রকেট ঘুড়িও৷ যার মূল্য পনেরো টাকা৷ হই হই করে বাজারে বিক্রি হচ্ছে৷ এই নিয়েও রয়েছে ক্ষোভ৷ ‘আমরা বিক্রেতা৷ ক্রেতার চাহিদা মতো জোগান তো দিতে হবে৷ অস্ট্রেলিয়ান কাগজে তৈরি প্রচলিত ঘুড়ির থেকে এই ধরনের প্লাস্টিকের ঘুড়ি অনেক বেশি টেকসই৷ বাচ্চাদের একটা কিনে দিলেই হল৷ কাগজের ঘুড়িতে তো তা হবে না৷ তাই লোকজন এই ধরনের ঘুড়ি চায়৷ এগুলোও কিন্ত্ত ক্ষতিকারক৷ কিন্ত্ত যেমন প্লাস্টিক ব্যাগও বন্ধ হয় না, এগুলোও হয় না৷ আসলে আমরাই তো খারাপ,’ শেষ কথাটা যেন নিজেকেই বলেই চুপ করে গেলেন ঘুড়ি ব্যবসায়ী বাবলুবাবু৷ এই প্লাস্টিকের ঘুড়িতে রয়েছেন দেশের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি-অভিনেত্রী সোনাক্ষী সিনহা থেকে ‘সুলতান’-‘রইস’-এর পোস্টার দেওয়া প্লাস্টিক ঘুড়ি৷ রয়েছে ছোটা ভীম-বার্বিও৷ চল্লিশ মাইক্রন প্লাস্টিক দিয়ে ঘুড়ি বানালে তা উড়বে না স্বাভাবিকভাবেই৷ তাই দূষণ তৈরি করা প্লাস্টিকেই তৈরি হচ্ছে ঘুড়ি, বিকোচ্ছেও৷ তবু আশা ঘুড়ি ওড়ানোর ইচ্ছার ঘাটতি, ঘুড়ি ব্যবসায় মন্দা কিংবা বেনিয়মের ঘুড়ি-মাঞ্জা সুতোর পরেও ঘুড়ি পাগল মানুষের জন্য আবারও দেখা যাবে আকাশে ঘুড়ির ঝাঁক, শোনা যাবে ভোঁ- কাট্টা….‘ওই নিয়ে আটটা’৷
অন্য সময়-এর মত
বিশ্বকর্মা পুজোয় ঘুড়ি ওড়ানো বাঙালির একটা ঐতিহ্য৷ বস্ত্তত দুর্গাপুজো সর্বজনীন থেকে বিশ্বজনীন হচ্ছে আর তার আগে-পরের পুজোগুলোর ঐতিহ্য যেন তত মিলিয়ে যাচ্ছে৷ বাঙালি শ্রমিক বিশ্বকর্মা পুজোয় আজও অনন্দ করেন, কিন্ত্ত গৃহস্থের বাড়ির ছাদে উঠে ছেসেছোকরাদের সারাদিন কাটানোটাও তো এ শহরের ঐতিহ্য৷ কেবল একটা দিন যদি ঐতিহ্যর পিছনে দেওয়া যায়, খারাপ কী? ঐতিহ্য নিয়ে বাড়াবাড়িও তো আজকের দিনে একটি বিশ্বজনীন প্রবণতা৷