জনসাধারণের উদ্দেশ্যে নেওয়া যে কোনও প্রকল্পের সূচনার প্রাথমিক লক্ষ্য হল জনকল্যান সাধন। কিন্তু ভালো-মন্দ মিলিয়েই এই সমাজ। কোথাও যদি মানুষের মুখে অন্ন জোগানোর প্রাণপণ চেষ্টা চলে, আবার কোথাও দেখা যায় তার ঠিক বিপরীত দৃশ্য। অর্থাৎ মানুষকেই বোকা বানানোর কাজ চলে সমান্তরালে। কখনও আবার সরকারি এই প্রকল্পগুলির মুনাফা তুলতে বহু মানুষ অনৈতিক পন্থা অবলম্বন করেন। অর্থাৎ যে মানুষগুলির এই প্রকল্পের সাহায্য দরকারই নেই, তাঁরাও প্রকল্পের আওতাভুক্ত হতে চান। অথচ অনেক ক্ষেত্রে তাঁরা ভুলে যান যে, অনৈতিক এবং বেআইনি ভাবে তিনি সাহায্য না নিলে হয়তো এমন আরও কিছু মানুষ সাহায্য পেতে পারতেন। যাঁদের প্রয়োজন আরও বেশি। এভাবেই দুর্নীতির শিকার হয়ে সুযোগ সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন এক বিরাট অংশের মানুষ। তাই রেশনিং ব্যবস্থায় বৈষম্য আর দুর্নীতি রোখাই প্রকল্পের অন্যতম উদ্দেশ্য। আশা করা যায় এই ব্যবস্থার সামগ্রীক বাস্তবায়নে প্রকল্পের প্রকৃত উদ্দেশ্য সাধিত হবে।
২০১৬ সালের ২৭ জানুয়ারি পশ্চিমবঙ্গ সরকারের তরফে মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ‘খাদ্য সাথী’ প্রকল্পের উদ্বোধন করেন। আর্থিক দিক থেকে অনগ্রসর পরিবারগুলিকে সাবলম্বী করে তোলার উদ্দেশ্যেই এই প্রকল্পও। এই প্রকল্পের আওতায় বাংলার প্রায় ৯০% অর্থাৎ কমবেশি ৭ কোটি মানুষ মাত্র ২ টাকা কিলো দরে চাল-গম কিনতে পারবেন। ফলে বাজারের সাধারণ মুদিখানার ৩৫-৪০ টাকা কিলো চাল কিংবা চড়া দামে আটা কেনার দরকার নেই আর। স্বল্পমূল্যেই এবার আটা কিনে রুটি বানানো যাবে।
‘খাদ্য সাথী’ প্রকল্পের এই সুযোগ সুবিধে নেওয়ার জন্য প্রত্যেকের রেশন কার্ড থাকা বাঞ্ছনীয়। ২০১৯ সাল থেকে চলতে থাকা অতিমারির কারণে এমনিতেই ডিজিটাল রেশন কার্ডের কথা ভেবেছিল সরকার। সাধারণ রেশন কার্ডের মাধ্যমে শুধু মাত্র এলাকার নির্দিষ্ট রেশন দোকান থেকে রেশন তোলার সুযোগ ছিল। কিন্তু ডিজিটাল রেশন কার্ডের মাধ্যমে দেশের যে কোনও প্রান্ত থেকে রেশন তোলার কাজটা সহজ হয়েছে। ফলে বাড়ি ফিরেই রেশন তোলার বাধ্যবাধকতা থাকছে না আর। তাই রেশন কার্ড ডিজিটাল করা অনেকটাই লাভজনক। ‘খাদ্য সাথী’র প্রকল্পের আওতায় প্রায় ৮ কোটি ডিজিটাল রেশন কার্ডও দেওয়ার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছিল।
‘খাদ্য সাথী’ প্রকল্পের নানা সুবিধে:
রেশন কার্ডের ধরন অনুযায়ী সাধারণ মানুষ পাবেন ‘খাদ্য সাথী’ প্রকল্পের সুবিধে। যেমন রেশন কার্ডকে ভাগ করা হয়েছে মূলত চার ভাগে। যেমন- অন্ত্যোদয় অন্ন যোজনা শ্রেণিভুক্ত কার্ড, পি এইচ এইচ শ্রেণিভুক্ত কার্ড, এস পি এইচ এইচ শ্রেণিভুক্ত কার্ড, রাজ্য সুরক্ষা যোজনা ১ ভুক্ত কার্ড, রাজ্য সুরক্ষা যোজনা ২ ভুক্ত কার্ড। এর মধ্যে ধার্য করা হয়েছে প্রত্যেকে পরিবার পিছু কত কিলোগ্রাম করে চাল এবং গম পাবেন। প্রত্যেক কিলো চাল এবং গমের দাম শুরু হয়েছে ২ টাকা থেকে।
এবার এক নজরে দেখে নেওয়া যাক কোন রেশন কার্ডের আওতায় কোন পরিবার কী মূল্যে এবং কত পরিমাণে রেশন থেকে কিনতে পারবেন এই চাল, গম।
সারণি | রেশন কার্ডের ধরন | প্রত্যেক মাসে কত করে চাল পাবেন? | প্রত্যেক মাসে কত করে গম পাবেন? | প্রত্যেক কেজি চালের দাম কত? | প্রত্যেক কেজি গমের দাম কত? |
১ | অন্ত্যোদয় অন্ন যোজনা শ্রেণিভুক্ত কার্ড | ১৫ কেজি | ২০ কেজি | ২ টাকা | ২ টাকা |
২ | পি এইচ এইচ শ্রেণিভুক্ত কার্ড, এস পি এইচ এইচ শ্রেণিভুক্ত কার্ড | ২ কেজি | ৩ কেজি | ২ টাকা | ২ টাকা |
৩ | রাজ্য সুরক্ষা যোজনা ১ ভুক্ত কার্ড | ২ কেজি | ৩ কেজি | ২ টাকা | ২ টাকা |
৪ | রাজ্য সুরক্ষা যোজনা ২ ভুক্ত কার্ড | ১ কেজি | ১ কেজি | ১৩ টাকা | ৯ টাকা |
আধার কার্ড এবং রেশন কার্ডের সম্পর্ক:
এ কথা বলাই বাহুল্য যে, এখনকার দিনে আধার কার্ড বহু জায়গায় বাধ্যতামূলক। এমনকি আধার কার্ডকেই পরিচয়পত্র হিসেবে গণ্য করা হচ্ছে। আবার বহু বছর ধরে রেশন কার্ডই ছিল মানুষের পরিছয়পত্র। অর্থাৎ কারও ঠিকানার প্রমাণ হিসেবে দর্শানো হত রেশন কার্ডই। এখন ধীরে ধীরে সেই জায়গাটা আধার কার্ড দখল করে নেওয়ায় মাঝ খানে রেশন কার্ডও গুরুত্ব হারাচ্ছিল। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে আর্থিক দিক থেকে পিছিয়ে পড়া মানুষের হাতে বেশি পরিমাণে ভর্তুকি দিয়ে খাদ্যশস্য তুলে দেওয়ার উদ্দেশ্যে ‘খাদ্য সাথী’ প্রকল্প চালুর সঙ্গে সঙ্গেই বেড়েছে রেশন কার্ডের গুরুত্বও। এই অবস্থায় রাজ্য সরকার ঘোষণা করেছে যে, আধার কার্ডের সঙ্গে রেশন কার্ড লিঙ্ক করা বাধ্যতামূলক। এর পিছনে রয়েছে নানা কারণ।
আধার কার্ডের সঙ্গে রেশন কার্ড লিঙ্ক করালে কী কী সুবিধে হবে?
১) এত দিন ধরে কত ভুয়ো রেশন কার্ড রয়েছে, তা বোঝা সহজ হবে। অনেক সময়েই দেখা যায় যে, পরিবারের কারও মৃত্যুর পরে তাঁর নামের রেশন কার্ডটিকে বাতিল করার উদ্যোগ নেয় না পরিবার। অর্থাৎ তাঁর নামের বরাদ্দ ভর্তুকি শস্য বা অন্যান্য সামগ্রীর ব্যবহার করে তাঁর পরিবার। আধার কার্ডের সঙ্গে রেশন কার্ড লিঙ্ক করা থাকলে সহজেই বোঝা সম্ভব যে, কেউ আদৌ মৃত ব্যক্তির রেশন কার্ড ব্যবহার করছেন কি না।
২) আবার এর উল্টোটাও বোঝা সম্ভব। ইতিমধ্যেই ভারতের প্রত্যেক নাগরিকের নামে আধার কার্ড হয়ে গেছে। রেশন কার্ড যদি আধার কার্ডের সঙ্গে লিঙ্ক করানো হয়, তা হলে এটা বোঝা সহজ হবে কার কার আধার কার্ড নেই। এবং পাশাপাশি কে কে ভুয়ো রেশন কার্ড এখনও ব্যবহার করে চলেছেন।
৩) রেশন কার্ড ভুয়ো না কি আধার কার্ড--- সেই বাছাইয়ের কাজটা যদি গৌণ বলে ধরেও নেওয়া যায়, তা হলে মুখ্য উদ্দেশ্য হল যাঁরা এত দিন ধরে অনৈতিক ভাবে রেশনের সুবিধে নিয়ে চলেছেন, সে ব্যাপারে দাঁড়ি টানা।
ফলে সহজেই বোঝা যায় যে, রেশন কার্ডের সঙ্গে আধার কার্ড সংযুক্ত করে রাখার কাজটা ভীষণ ভাবে বাধ্যতামূলক।
কোন পদ্ধতিতে রেশন কার্ড এবং আধার কার্ডের সংযুক্তিকরণ?
অতিমারির কথা মাথায় রেখে পশ্চিমবঙ্গ সরকার অনলাইনে অর্থাৎ ঘরে বসেই আধার কার্ড এবং রেশন কার্ড লিঙ্ক করার কাজটি সম্পন্ন করার কথা ভেবেছে। আবার গ্রামের দিকে বা যাঁদের কাছে এখনও পর্যন্ত অনলাইনে এই ব্যবস্থা গ্রহণের পরিস্থিতি নেই, তাঁদের কথা ভেবে অফলাইনেও রেখেছে সংযুক্তিকরণের কাজ। এ ছাড়া পশ্চিমবঙ্গ সরকারের খাদ্য এবং সরাবরাহের দ্বারা নিযুক্ত ওয়েবেল টেকনোলজি লিমিটেডের সার্ভেয়ারদের কাছে বায়োমেট্রিক পদ্ধতিতে আঙুলে ছাপ দিয়ে রেশন কার্ডের সঙ্গে আধার কার্ড এবং মোবাইল নম্বর সংযুক্তিকরণের কাজটা করানো যেতে পারে। সার্ভেয়াররা মানুষের বাড়ি বাড়ি গিয়ে রেশন কার্ড এবং আধার কার্ড লিঙ্ক করানোর কাজটি করছেন। যাঁরা নিজেরা অনলাইনে লিঙ্কিংয়ের কাজটি একাই করতে পারবেন, তাঁরা ল্যাপটপ কিংবা কম্পিউটারের মাধ্যমে তা করতে পারেন। এর সঙ্গে ইন্টারনেট কানেকশন থাকা বাধ্যতামূলক। আর যাঁরা নানা অসুবিধে থাকার কারণে অনলাইনের পরিবর্তে অফলাইনে লিঙ্ক করানোয় স্বচ্ছন্দ বোধ করবেন, তাঁরা সার্ভেয়ারদের বাড়িতে আসা পর্যন্ত অপেক্ষা না করে বরং চলে যেতে পারেন এলাকার নিকটস্থ রেশন দোকানে। সেখানে প্রয়োজনীয় নথি জমা দিয়ে করিয়ে নিতে পারেন রেশন কার্ডের সঙ্গে আধার কার্ডের এই সংযুক্তিকরণের কাজটি।
এ কথা এখন স্পষ্ট যে, যদি দীর্ঘমেয়াদি ভাবে সরকারের দেওয়া ভর্তুকিতে চাল, গম-সহ অন্যান্য জরুরি জিনিস রেশন দোকান থেকে কিনতে চান, তা হলে আধার কার্ডের সঙ্গে নিজের রেশন কার্ডের লিঙ্ক না করানো ছাড়া অন্য কোনও উপায় নেই। তাই সময় থাকতেই সচেষ্ট হন।
তথ্য সহায়তা:
১) https://wbpds.gov.in/
রাজ্য ও কেন্দ্রের সব সরকারি প্রকল্পের যাচাই করা তথ্য ও খবর জানতে অবশ্যই ক্লিক করুন এই সময়ের সরকারি প্রকল্প পেজে।