অ্যাপশহর

রাজের রাজপ্রাসাদে

আগুন ধ্বংস করে দিয়েছে রাজ কাপুরের ‘আর কে স্টুডিও’। ঋষির আশ্বাস ফের গড়ে তোলা হবে।

EiSamay.Com 10 Oct 2017, 2:19 pm
আগুন ধ্বংস করে দিয়েছে রাজ কাপুরের ‘আর কে স্টুডিও’। ঋষির আশ্বাস ফের গড়ে তোলা হবে। তবুও পুড়ে ছাই সমস্ত রাজ-স্মৃতি। সেই স্মৃতির সরণিতে সুমিত দে
EiSamay.Com mumbai rk studio fire destroys precious memorabilia including raj kapoors mera naam joker costume mask
রাজের রাজপ্রাসাদে



ভয়াবহ বন্যা৷ বানভাসি জলে ভাসছে গ্রাম৷ ডুবে গিয়েছে মন্দির৷ শেষ দৃশ্য৷ ধীরে ধীরে কমছে জল৷ ক্রমশ দৃশ্যমান মন্দিরের রাধা -কৃষ্ণ৷ মূর্তি অটুট! ভয়াল বন্যা এতটুকুও আঁচ ফেলতে পারেনি প্রেম -মূর্তিতে ! এই দৃশ্য কল্পনার , ছবির৷ রাজ কাপুর পরিচালিত ‘সত্যম শিবম সুন্দরম ’-এর৷ কিন্ত্ত বাস্তবে ? ভয়াল আগুন কি বাঁচাতে পারল রাজের মন্দির ‘আর কে স্টুডিও ’? না , পারেনি৷ লেলিহান শিখায় ঝলসে গিয়েছে রুপোলি পর্দার ‘রাধা -কৃষ্ণ ’, রাজ -নার্গিস৷ স্টুডিওর গেটের সামনে খোদাই করা ‘বরসত ’ ছবির ‘যুগল -মূর্তি’৷

১৬ সেপ্টেম্বর ২০১৭৷ শনিবার , দুপুর ২.২০৷ ভয়ানক আগুনে পুড়ে ছাই ভারতীয় সিনেমার ‘অলঙ্কার ’, বলিউডের ‘অহঙ্কার ’ প্রায় সত্তর বছরের ‘আর কে স্টুডিও ’৷ টেলিভিশন রিয়্যালিটি শো ‘সুপার ডান্সার , সেশন -টু’ চলাকালীন লেগেছিল আগুন৷ ‘আগ ’ নেভাতে ছুটে এসেছিল দমকলের পাঁচ -পাঁচটি জলের গাড়ি৷ কিন্ত্ত তার আগেই ক্ষতি যা হওয়ার হয়ে গিয়েছে৷

‘স্টুডিও আবার তৈরি করা যেতেই পারে৷ কিন্ত্ত আগুন যে ক্ষতি করে দিল , তার অভাব পূরণ করার নয়৷ আর কি ফিরে পাওয়া যাবে সেই স্মৃতি ?’ অগ্নিকাণ্ডের পর , এ কথা ট্যুইট করে জানিয়েছেন , রাজের মেজ পুত্র ঋষি কাপুর৷

আগুন নেভানোর পর্যান্ত জল নাকি ছিল না স্টুডিওয় ! ছিল না অগ্নি -নির্বাপক আধুনিক যন্ত্র -পদ্ধতি৷ যা ছিল , সবই পুরনো৷ অ্যাদ্দিনে তা ধরা পড়েছে , ‘মুম্বই ফায়ার ব্রিগেড ’-এর কর্তাদের অনুসন্ধানে৷ আর সেই কারণে , তাঁরা একটি শো -কজ নোটিশও ধরিয়ে দিয়েছেন কাপুর -পরিবারকে !অবাক কাণ্ড ! কাপুর -পরিবার কেন ? সিনেমাপ্রেমী -মাত্রই জানেন এই ‘পানি ’ কতখানি প্রিয় ছিল রাজের৷ তাঁর ছবিতে , ‘প্যার হুয়া ইকরার হুয়া ...’ (শ্রী ৪২০ ), ‘ভোর ভয়ি পঙ্ঘাটপে ’ (সত্যম শিবম সুন্দরম ), ‘মেরেহি পাশ তুঝে আনা হ্যায় , তেরেহি পাশ মুঝে যানা হ্যায় ...’(রাম তেরি গঙ্গা ময়লি )... রাজের গান মানেই জলধারা৷ রাজ মানেই জলস্রোত৷

লিখতে গিয়ে তাই বারবার মনে পড়ছে , রাজকীয় রাজ -রহস্য৷ তাঁর গহন -গোপন প্রেম -কাহানি৷ ‘সাব , অন্দর যানা মানা হ্যায়৷ ’ স্টুডিওর গেটে দাঁড়াতেই , এগিয়ে এল নিরাপত্তারক্ষী৷ নম্রভাবে জানাল , ভিতরে যাওয়া বারণ৷ মুম্বইয়ের চেম্বুরে , রাস্তার উপর স্টুডিও৷ বিশাল দরজা৷ একপ্রান্তে নিরাপত্তাকর্মীর ঘর৷ তার গায়ে সাদা কংক্রিটে , লাল রঙে জ্বলজ্বল করছে লেখা , ‘আর কে স্টুডিও অ্যান্ড ফিল্মস ’৷ তার একটু উপরে মাত্র দুটি অক্ষর ...‘আর কে ’৷ লাগোয়া খোদাই করা ‘বরসত ’ ছবির সেই বিখ্যাত দৃশ্য৷ ছবির নায়ক রাজের বাহুলগ্না , নায়িকা নার্গিস৷

সময় সকাল সাড়ে বারোটা৷ হঠাত্ই ভিতর থেকে বেরিয়ে এল একটি গাড়ি৷ দরজা খুলল সটান৷ চোখের সামনে স্টুডিওর খোলা চত্বর৷ অল্প দূরে দৃশ্যমান দফতর৷ কেয়ারি করা বাগানের মাঝে , দু-তিনটি সিঁড়ির ধাপ উঠলেই৷ সিঁড়ির সামনে রাখা দামি স্টিল রঙের গাড়ি৷ তার মানে ...‘কার গাড়ি ওটা ?’ জানতে চাইতে নিরাপত্তাকর্মী জানাল , ‘রণধীরসাব আয়ে হ্যায়৷ ’ শোনামাত্র তাকে বলেছিলাম , ‘সাবকো বোলিয়ে মিলনা চাহতা হুঁ’৷ এরপর প্রতীক্ষা৷ কিছুক্ষণ পর , নিরাপত্তারক্ষী এসে জানাল , ‘অন্দর যাইয়ে ’৷ পা রেখেছিলাম বিনোদন জগতের বিস্ময় , ভারতীয় সিনেমার কিংবদন্তি স্টুডিও -চত্বরে৷ তারিখ ২৪ মার্চ, ২০১২৷

ঢুকতেই বিশাল ঘর৷ বেশ মলিন৷ কে বলবে , ভারতীয় সিনেমার এটাই জাদুঘর ! চারদিকে থরে থরে সাজানো পুরস্কার৷ রাজের ছবির আসল পোস্টার৷ মনে অজান্তে যেন এসে যায় ফ্ল্যাশব্যাক৷

শোনা কথা , জীবনে দু’বার৷ রাজের চোখে নাকি জল দেখেছিলেন , তাঁর একান্ত কাছের মানুষরা৷ প্রথম ঘটনার সাক্ষী , স্টুডিওয় তাঁর একান্ত -নিজস্ব ঘর৷ সাল ১৯৫৮৷ রাজ সেদিন জানতে পেরেছিলেন , সুনীল দত্তকে বিয়ে করেছেন নার্গিস৷ কোন নার্গিস ? বলিউড ততদিনে জেনে গিয়েছে , নার্গিস মানেই রাজ , আর রাজ মানেই নার্গিস৷ ১৯৪৮ থেকে ১৯৫৬৷ ‘আগ ’, ‘আন্দাজ ’, ‘বরসত ’, ‘আওয়ারা ’, ‘শ্রী ৪২০ ’...জুটিতে প্রায় ১৬টি ছবি করার সুবাদে , নার্গিস তখন শুধু রাজের প্রেয়সীই নন৷ প্রেরণা , প্রাণশক্তি৷ ‘আর কে ’-র সমার্থক , সমান্তরাল৷

বলিউডের বাতাস বলে , নার্গিস মনে -প্রাণে চেয়েছিলেন রাজকে বিয়ে করতে৷ কিন্ত্ত স্ত্রী কৃষ্ণা , তিন পুত্র রণধীর -ঋষি -রাজীব , দুই কন্যা রীতু, রীমাকে ছেড়ে , কিছুতেই নার্গিসের হাত ধরে ঘর ছাড়তে রাজি হননি রাজ৷ আহত -অভিমানী নার্গিস ‘মাদার ইন্ডিয়া ’ ছবির শ্যুটিং চলাকালীন আচমকাই বিয়ে করে নেন , ছবির নায়ক সুনীল দত্তকে৷ ‘আর কে ’ স্টুডিওয় বসে সেই খবর শোনামাত্র , রাজ নাকি আর সেদিন পা রাখেননি স্টুডিওর বাইরে৷ ঘরের দরজা এঁটে, একাকী ফেলেছিলেন চোখের জল৷

রাজের রাজপ্রাসাদেআগুন ধ্বংস করে দিয়েছে রাজ কাপুরের ‘আর কে স্টুডিও ’৷ ঋষির আশ্বাস ফের গড়ে তোলা হবে৷ তবুও পুড়ে ছাই সমস্ত রাজ -স্মৃতি৷ সেই স্মৃতির সরণিতে সুমিত দেএরপর তিনের পাতায়রাজের চোখে নাকি মাত্র দু’বার জল দেখেছিলেন তাঁর কাছের মানুষরা৷ প্রথম ঘটনার সাক্ষী তাঁর স্টুডিও৷ রাজ যেদিন জানতে পারেন সুনীল দত্তকে বিয়ে করেছেন নার্গিস ...তখনও অক্ষত রাজ কাপুরের ব্যবহূত সামগ্রী৷ ‘আর কে স্টুডিও ’ মুম্বইতে৷ দ্বিতীয় সারিতে অগ্নিকাণ্ডের ছবি৷ শেষের সারিতে ‘আর কে ফিল্মস ’-এর জনপ্রিয় কয়েকটি ছবি৷

এর কয়েক বছর পরের ঘটনা৷ ততদিনে ‘মেরা নাম জোকার ’ (১৯৭০ ) সুপার ফ্লপ৷ রাজ দিশেহারা৷ দাদার মনের অবস্থা বুঝে , ভাই শাম্মী কাপুরই রাজের জন্মদিনে দিয়েছিলেন এক জম্পেশ পার্টি৷ তাতে বলিউডের তারার ভিড়ে ,আমন্ত্রণ ছিল নার্গিসেরও৷ এসেছিলেন নার্গিস৷ এসে পার্টির মধ্যমণি হয়ে , উগরে দিয়েছিলেন তাঁর জমা রাগ৷ রাজের দ্বারা আর কিছু হবে না৷ রাজ শেষ৷ তাঁর সেই কথা , পৌঁছেছিল পার্টিতে উপস্থিত স্বয়ং রাজের কানে৷ যদিও এরপর তিনি তৈরি করেন ‘ববি ’৷ কিন্ত্ত ‘রাজ শেষ ’, নার্গিসের মুখের সেই কথায় নাকি সেদিন , সকলের অলক্ষ্যে দেখা গিয়েছিল ভারতীয় ‘চার্লি’-র চোখে জল৷

আগুন নেভানোর প্রয়োজনীয় জল নাকি ছিল না স্টুডিয়৷ তাই আজ তা ধ্বংসাবশেষ৷ ধ্বংসের মাঝে , এক ঝলক দেখে নেওয়া যাক সৃষ্টি৷ ‘আর কে ’ স্টুডিওর ইতিহাস৷ সাল ১৯৪৮৷ অভিনেতা পৃথ্বীরাজ কাপুরের ছয় সন্তানের বড় পুত্র ২৪ বছর বয়সী রাজ (রণবীর রাজ কাপুর ), চেম্বুরে বিশাল এলাকা জুড়ে তৈরি করেন তাঁর নামাঙ্কিত এই স্টুডিও৷ আর সেই বছরই নার্গিসকে নায়িকা করে , তাঁর ছবি ‘আগ ’৷ ছবি সাফল্য না পেলেও , পরের বছরই নার্গিসের সাথে তাঁর ‘বরসত ’ সুপার হিট৷ তারপরই ‘আওয়ারা ’, ‘বুট পালিশ ’, ‘শ্রী ৪২০ ’...পর পর ছবি হিট হওয়ায় , ১৯৬৪ সালে রাজ -বৈজয়ন্তীমালা জুটিতে তৈরি হয় ‘আর কে ’-র প্রথম রঙিন ছবি ‘সঙ্গম ’৷ যা তুমুল আলোড়ন তোলে৷

এর কিছু সময় পর , ‘মেরা নাম জোকার ’ (১৯৭০ )৷ ছ’বছর সময় নিয়ে রাজ এই ছবি বানালেও , বক্স -অফিসে তা মুখ থুবড়ে পরে৷ যদিও ১৯৭৩ -এ ঋষি -ডিম্পল জুটিতে ‘ববি ’, ১৯৭৮ -এ শশী -জিনতের ‘সত্যম শিবম সুন্দরম ’, ১৯৮২ -তে ঋষি -পদ্মিনীর ‘প্রেম রোগ ’, ১৯৮৫ -তে রাজীব -মন্দাকিনীর ‘রাম তেরি গঙ্গা ময়লি ’, রাজের ছবি মানেই বাম্পার হিট৷ সিনেমাপ্রেমী রাজ -ক্যারিশ্মায় মোহিত৷

সাল ১৯৮৮৷ রাজকে সম্মান জানানো হয়েছিল ‘দাদা সাহেব ফালকে ’ পুরস্কারে৷ কিন্ত্ত সেই সময়ই ২ জুন (১৯৮৮ ), ৬৩ বছর বয়সে অ্যাস্থমা -আক্রান্ত হয়ে , সকলকে কাঁদিয়ে চলে যান ভারতীয় সিনেমার ‘গ্রেটেস্ট শো -ম্যান ’৷ সেই বছরই ঋষি , জেবা বাখতিয়ারকে নিয়ে তিনি শুরু করেছিলেন ‘হেনা ’৷ তাঁর আকস্মিক মৃত্যুতে , রণধীর পরিচালনা করেন সেই ছবি৷ যা মুক্তি পায় ১৯৯১ সালে৷

রাজের সেই স্মৃতির সাদা -কালো রূপকথার ঘোরে , হঠাত্ই কানে এল রণধীরের কথা , ‘প্লিজ , একটু তাড়াতাড়ি৷ আমি বেরব৷ ’ সুতরাং সময় কম৷ তার মঝেই ঘুরে দেখেছিলাম বিস্ময় -বিমোহের বিরল স্টুডিও -চত্বর৷ চারদিকে কাচের শো -কেসে সাজানো স্মৃতি৷ নানা ছবি , রাজের ছবিতে ব্যবহূত নায়ক -নায়িকার কস্টিউম৷

বিশাল দফতরে ঢুকেই চোখ আটকে যায় , বিরাট ফ্রেমে বাঁধানো পৃথ্বীরাজ কাপুর , রাজ কাপুরের রঙিন ছবির ক্যানভাসে৷ বাঁ-হাতে কাচের শো -কেসে সাজানো নানা স্মারক৷ যেন এক সম্মোহ সহবস্থান ! ইতিউতি সজ্জিত ‘শ্রী ৪২০ ’, ‘জিস দেশমে গঙ্গা বহেতি হ্যায় ’, ‘দাদা সাহেব ফালকে ’...তিনটি ‘ন্যাশনাল ফিল্ম অ্যাওয়ার্ড’৷ ঝকঝকে কাচের ভিতর সুসজ্জিত , রাজের এগারোটা ‘ফিল্ম ফেয়ার অ্যাওয়ার্ড’৷

রাজের পর থেকেই চালু হয়েছিল , ‘ফিল্ম ফেয়ার লাইফটাইম অ্যাচিভমেন্ট অ্যাওয়ার্ড’৷ তাঁর দুটি ছবি , ‘আওয়ারা , ‘বুট পালিশ ’ নমিনেশনের জন্য গিয়েছিল ‘কান ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল ’৷ ‘আওয়ারা ’ ছবিতে তাঁর অভিনয় বিবেচিত হয়েছিল ‘টপ টেন গ্রেটেস্ট পারফরমেন্স অফ অল টাইম বাই টাইম ম্যাগাজিন ’৷ এই স্টুডিওতেই সযত্নে রক্ষিত ছিল ‘আর কে ’ ব্যানারের সুপার -হিট ছবির নানা কস্টিউম৷ যা আগুনে পুড়ে আজ ছাই৷

‘যা পুড়ে শেষ হওয়ার , তা তো হয়েছেই৷ এবার আধুনিক টেকনলোজিতে ফের নতুন করে তৈরি হবে ‘আর কে ’ স্টুডিও৷ ’ ট্যুইটে এ -কথা জানিয়েছেন ঋষি কাপুর৷ শুধু ঋষি নন , গোটা কাপুর -পরিবারই জানেন , যে ‘আগ ’ (১৯৪৮ ) দিয়ে সৃষ্টি হয়েছিল ভারতীয় সিনেমার আইকনিক স্টুডিও ‘আর কে ’, সামান্য ‘আগ ’ তাকে কিছুতেই ধ্বংস করতে পারে না৷ কারণ কাপুর -রক্তে আজও অনুচ্চারে অনুরণিত রাজ -রহস্য ...‘দ্য শো মাস্ট গো অন ’৷

পরের খবর

Entertainmentসম্পর্কে আরও বিস্তারিত ও নতুন খবর জানতে ক্লিক করুন। সব ধরনের ব্রেকিং, আপডেট এবং বিশ্লেষণ সবার প্রথম বাংলায় পড়তে ক্লিক করুন Bengali Newsএই সময় ডিজিটাল