প্রশান্ত ভট্টাচার্য 'নির্বাচন শেষ। মোর্চা শেষ।' অর্থাৎ ভোট শেষ। জোট শেষ। সীতারাম ইয়েচুরির (Sitaram Yechury) এই ছোট্ট ঘোষণা অনেক আলাপের জন্ম দিল। প্রথমেই একটা দিনের ছবি চোখের সামনে ভেসে উঠল। ২৮ ফেব্রুয়ারি, ২০২১। ব্রিগেডের ময়দানে বাম, কংগ্রেস ও আইএসএফ নেতাদের হাত ধরাধরির ছবি। ঘোষিত হল 'সংযুক্ত মোর্চা' (Sanjukta Morcha)। যার ইন্তেকাল রচিত হল ১৭ সেপ্টেম্বর বার জুম্মাতে ইয়েচুরির ঘোষণায়। কে কার সঙ্গে ঘর করবে, আর কে কার সঙ্গে হনিমুনে যাবে, সেটা যেমন ব্যক্তি স্বাধীনতার বিষয় তেমনই কোন রাজনৈতিক দল কার হাত ধরবে তা-ও দলগুলির নিজস্ব ব্যাপার। কিন্তু যেহেতু প্রতিটি রাজনৈতিক দলের অস্তিত্ব নির্ভর করে জন-অনুমোদনের উপর এবং দলগুলিও তা আশা করে, তাই কোনও দলের সিদ্ধান্ত জনমানসে কতটা প্রতিক্রিয়া তৈরি করছে, তা বিচার্য। বিশেষ করে দলগুলির পলিটিক্যাল অডিট-এ তা গুরুত্ব পায়।
আমাদের রাজ্যে একসময় অকল্পনীয় ছিল যে, CPIM কংগ্রেসের 'কাটা' হাত ধরে নির্বাচনি বৈতরণী পার হবে! (ঠিক এখনও যেমন এই ধারণাটি কল্পনাই করতে পারে না কেরালার CPIM বা কংগ্রেস)। কিন্তু ২০১৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনের সময় আমরা সেটাই হতে দেখলাম। অবিশ্বাস্যকে সত্যি করে বিধানসভা ভোটে হাত মিলিয়েছিল বাম ও কংগ্রেস। কয়েকটি আসনে সমঝোতা না হলেও অধিকাংশ আসনেই হাতে হাত মিলিয়েছিল দু'পক্ষই। আর সেই জোটকে ঘিরে রীতিমতো আলোড়ন তৈরি হয়েছিল বাংলার রাজনৈতিক মহলে। কলকাতার একটি নির্বাচনী জনসভায় কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধী ও বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য একই মালায় গলা ঢোকালেন। দুই দলের সমবেত কর্মী-সমর্থকদের মুহুর্মুহু করতালিতে বাঁধা রইল সেই বন্ধন। খানিকটা 'ধরি মাছ না ছুঁই পানি'র মতো ২০১৬ সালে বাম-কংগ্রেস সমঝোতায় হাবভাব ছিল CPIM-এর। জোট বলতে নারাজ ছিলেন CPIM নেতারা। এমনকী, সিঙ্গুরের জনসভায় অধীর চৌধুরী বক্তৃতা করে নেমে যাওয়ার পরে মঞ্চে উঠলেন CPIM সাধারণ সম্পাদক সীতারাম ইয়েচুরি। অথচ তিনি এসেছেন অধীর বক্তৃতা করার আগেই। এই বসন রাঙানো কমরেডদের নিয়ে ঘেঁটে যাওয়ার জায়গা অনেক। যাই হোক সেই ২০১৬ সালে নির্বাচনে অবশ্য সাফল্যের মুখ দেখেনি জোট। তবে CPIM ও কংগ্রেস দুই তরফেরই প্রতিশ্রুতি ছিল, ভবিষ্যতে জোট আরও শক্তিশালী হবে। কিন্তু আমরা দেখলাম চার মাস কাটতে না কাটতে সবটাই ভেঙে চৌচির। কোনও আলোচনা না করেই তিনটি আসনের উপনির্বাচনে বামরা তাঁদের প্রার্থীর নাম ঘোষণা করে দিলেন। অনিবার্য ভাবেই জোটের বা সমঝোতার আর সুযোগ রইল না। তবে তারপর থেকে পরিষদীয় রাজনীতিতে কাছাকাছি থাকলেও রাস্তাঘাটের কর্মসূচিতে আর দেখা যায়নি দুই শিবিরের নেতাদের।
যদিও ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনের আগে কংগ্রেস দোদুল্যমান ছিল তৃণমূলের সঙ্গে জোট করবে না বামদের সঙ্গে আসন সমঝোতা করবে, এই ধন্দে। ওই সময় কংগ্রেস নেতা সোমেন মিত্র দলের হাইকমান্ডকে জানিয়েছিলেন, 'তৃণমূলের সঙ্গে জোট করলে আমাদের আসন সংখ্যা বাড়বে, কিন্তু দলটা উঠে যাবে।' তাঁর সেই পর্যবেক্ষণকে গান্ধী পরিবার গুরুত্ব দিয়েছিল। জোট হয়নি। না তৃণমূলের সঙ্গে, না বামদের সঙ্গে। ভোটের ফল আমরা জানি, কংগ্রেস-২, বাম -০। ১৮টি আসন জিতে বিরোধীদলের পরিসরটা পুরোপুরি দখল করে নিল বিজেপি। সেই শিক্ষা থেকে একুশের ভোটের অনেক আগেই জোট গড়ার জন্য মূলত উদ্যোগী হন আলিমুদ্দিন স্ট্রিটের কর্তারা। সেই উদ্যোগের সাফল্যই লাইমলাইটে নিয়ে এল পীরজাদা আব্বাস সিদ্দিকিকে। ব্রিগেডের জমায়েতে তা-ই প্রতিফলিত হল। কিন্তু ভোটের ফলে দেখা গেল, শিবরাত্রির সলতের মতো সিদ্দিকির আইএসএফ-এর মাত্র একজন বিধায়ক। বাম ও কংগ্রেস শূন্য। আর হাতে রইল ঝান্ডাতেই মোর্চার প্রাসঙ্গিকতা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে শুরু করল। শুক্রবার সাংবাদিক বৈঠকে CPIM-এর সাধারণ সম্পাদক সীতারাম ইয়েচুরি সেই জোটের ঘোঁট সাফা করে দিলেন। অধীর চৌধুরীর স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া, '২০১৬ সালে জোট হয়েছিল। আমাদের সঙ্গে আলোচনা না করে ওঁরা নিজেরা তা ভেঙে দিয়েছিলেন। ২০২১ সালে আবার জোট হল। উভয়ে হেরেছি। তাঁরা মনে করছেন, জোটের দরকার নেই। আমরা এ কথা বলিনি।' অন্য দিকে, মোর্চার একমাত্র বিধায়ক নাওশাদ সিদ্দিকির সাফ কথা, 'আমার মনে হয় যদি এটা ভাঙারই হয়, তবে সীতারাম ইয়েচুরি স্যারের মুখ থেকে নয়, বামেদের যে চেয়ারম্যান আছেন বিমান বসু, আমরা তাঁর মুখ থেকে শুনতে চাই। তিনি ঘোষণা করে দিন, সংযুক্ত মোর্চার প্রাসঙ্গিকতা আর নেই, এটা ডিজলভ করে দেওয়া হল। তাহলে বাংলার মানুষের কাছে এটা ক্লিয়ার হয়ে যাবে।' রাজনীতিতে নবীন নাওশাদের কথার মধ্যে দুটি জিনিস বেরিয়ে আসছে। এক, তাঁরা ওই সব পলিটব্যুরো দেখে মোর্চায় আসেননি। দুই, জোট রাজনীতি ছেলের হাতের মোয়া নয়, তার কিছু নৈতিক দিকও আছে।
নাওশাদ আবেগে যা-ই বলুন, বাম-কংগ্রেস-আব্বাসের জোট কতটা নীতিসম্মত, তা নিয়ে ভোটের সময়েও প্রশ্ন উঠেছিল। রাজ্য CPIM শূন্য হতেই ফল বেরোনোর সন্ধ্যায় পরাজিত বিধায়ক তন্ময় ভট্টাচার্য টিভি চ্যাটে আইএসএফ-কে নিয়ে মোর্চা করা প্রসঙ্গেই প্রশ্ন তুলে দিয়েছিলেন। তিনি নাম না করে বিঁধেছিলেন মহম্মদ সেলিমকে। পরে CPIM রাজ্য কমিটিতে কৌশল নিয়ে প্রশ্ন করেছিলেন অনেকেই। বাম শরিকদের কারও কারও দাবি ছিল, কংগ্রেস আর আইএসএফ-কে নিয়ে ভোটে লড়ার ফলেই মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন সাধারণ সমর্থকরা। তখনই জোট বা মোর্চার ভবিষ্যৎ নিয়ে দেয়াল লিখন পড়া যাচ্ছিল। জোটের ভবিষ্যৎ নিয়ে কেন্দ্রীয় কমিটির প্রশ্নের মুখেও পড়েছিলেন রাজ্যের নেতারা। সেই কেন্দ্রীয় কমিটির বৈঠকের দ্বিতীয় দিনে সীতারাম ইয়েচুরি, প্রকাশ কারাটরা সাফ জানিয়ে দেন, নির্বাচনের সময় মোর্চা গড়া সঠিক হলেও তা কখনই দীর্ঘস্থায়ী জোট হতে পারে না। যদি দীর্ঘস্থায়ী জোটের ভাবনা থাকে, তা হলে তা সঠিক হবে না। পরে রাজ্য কমিটির বৈঠকেও বঙ্গমুখী সাধারণ সম্পাদক ইয়েচুরি জোট করার আদিখ্যেতা নিয়ে কঠিন ভাষায় সমালোচনা করেন। আর গত শুক্রবার ইয়েচুরি তা পরিষ্কার করে দিলেন, ভোট শেষ, জোটও শেষ।
ইয়েচুরি বা CPIM কেন্দ্রীয় কমিটির এ দিনের বক্তব্যে আরও একবার প্রশ্ন তুলে দিল, জোট কি তবে কেবলমাত্র নির্বাচনী সাফল্যের জন্যই? এমনটা হলে তো ভবিষ্যতেও জোটের বিশ্বাসযোগ্যতা থাকবে না। রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরা স্মরণ করিয়ে দিলেন, ১৯৭৭ সালে ইন্দিরা গান্ধীকে ক্ষমতাচ্যুত করেছিল বিরোধী জোট। সে উদাহরণ দিয়ে ইয়েচুরিও এদিন বলেন, 'ইমিডিয়েট পারপাসের জন্য ফ্রন্ট তৈরি হয়। ইভেন্ট শেষ হলে পারপাস থাকে না।' তাই ৩ বছরের মধ্যেই ইন্দিরা গান্ধী ক্ষমতায় ফেরেন। আর সেটা ফেরেন বিরোধীরা জোট রাজনীতির ধর্ম বজায় রাখতে পারেন না বলেই। যে যার অ্যাজেন্ডা নিয়ে মাঠে নেমে পড়েছিলেন বলেই। এখন বাংলাতেই এই অবস্থা হলে ২০২৪ সালে সর্বভারতীয় মঞ্চে মোদী-বিরোধী জোটের কী হাল হবে? কী যে হবে, তার একটা স্পেসিমেন শুক্রবার তৃণমূলের মুখপত্রে বেরিয়ে পড়েছে। তৃণমূল দাবি করেছে, ২০১৪ ও ২০১৯ সালের ভোটে রাহুল গান্ধীকে মুখ করে বিরোধীদের পরাজয় হয়েছে। তাই রাহুল নন, ২৪-এ মোদী-বিরোধী মুখ হবেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
(এই প্রবন্ধে প্রকাশিত মতামত সম্পূর্ণ ভাবে লেখকের ব্যক্তিগত। এই সময় ডিজিটাল কোনও ভাবেই লেখার দায়ভার বহন করে না।)
আমাদের রাজ্যে একসময় অকল্পনীয় ছিল যে, CPIM কংগ্রেসের 'কাটা' হাত ধরে নির্বাচনি বৈতরণী পার হবে! (ঠিক এখনও যেমন এই ধারণাটি কল্পনাই করতে পারে না কেরালার CPIM বা কংগ্রেস)। কিন্তু ২০১৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনের সময় আমরা সেটাই হতে দেখলাম। অবিশ্বাস্যকে সত্যি করে বিধানসভা ভোটে হাত মিলিয়েছিল বাম ও কংগ্রেস। কয়েকটি আসনে সমঝোতা না হলেও অধিকাংশ আসনেই হাতে হাত মিলিয়েছিল দু'পক্ষই। আর সেই জোটকে ঘিরে রীতিমতো আলোড়ন তৈরি হয়েছিল বাংলার রাজনৈতিক মহলে। কলকাতার একটি নির্বাচনী জনসভায় কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধী ও বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য একই মালায় গলা ঢোকালেন। দুই দলের সমবেত কর্মী-সমর্থকদের মুহুর্মুহু করতালিতে বাঁধা রইল সেই বন্ধন। খানিকটা 'ধরি মাছ না ছুঁই পানি'র মতো ২০১৬ সালে বাম-কংগ্রেস সমঝোতায় হাবভাব ছিল CPIM-এর। জোট বলতে নারাজ ছিলেন CPIM নেতারা। এমনকী, সিঙ্গুরের জনসভায় অধীর চৌধুরী বক্তৃতা করে নেমে যাওয়ার পরে মঞ্চে উঠলেন CPIM সাধারণ সম্পাদক সীতারাম ইয়েচুরি। অথচ তিনি এসেছেন অধীর বক্তৃতা করার আগেই। এই বসন রাঙানো কমরেডদের নিয়ে ঘেঁটে যাওয়ার জায়গা অনেক। যাই হোক সেই ২০১৬ সালে নির্বাচনে অবশ্য সাফল্যের মুখ দেখেনি জোট। তবে CPIM ও কংগ্রেস দুই তরফেরই প্রতিশ্রুতি ছিল, ভবিষ্যতে জোট আরও শক্তিশালী হবে। কিন্তু আমরা দেখলাম চার মাস কাটতে না কাটতে সবটাই ভেঙে চৌচির। কোনও আলোচনা না করেই তিনটি আসনের উপনির্বাচনে বামরা তাঁদের প্রার্থীর নাম ঘোষণা করে দিলেন। অনিবার্য ভাবেই জোটের বা সমঝোতার আর সুযোগ রইল না। তবে তারপর থেকে পরিষদীয় রাজনীতিতে কাছাকাছি থাকলেও রাস্তাঘাটের কর্মসূচিতে আর দেখা যায়নি দুই শিবিরের নেতাদের।
যদিও ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনের আগে কংগ্রেস দোদুল্যমান ছিল তৃণমূলের সঙ্গে জোট করবে না বামদের সঙ্গে আসন সমঝোতা করবে, এই ধন্দে। ওই সময় কংগ্রেস নেতা সোমেন মিত্র দলের হাইকমান্ডকে জানিয়েছিলেন, 'তৃণমূলের সঙ্গে জোট করলে আমাদের আসন সংখ্যা বাড়বে, কিন্তু দলটা উঠে যাবে।' তাঁর সেই পর্যবেক্ষণকে গান্ধী পরিবার গুরুত্ব দিয়েছিল। জোট হয়নি। না তৃণমূলের সঙ্গে, না বামদের সঙ্গে। ভোটের ফল আমরা জানি, কংগ্রেস-২, বাম -০। ১৮টি আসন জিতে বিরোধীদলের পরিসরটা পুরোপুরি দখল করে নিল বিজেপি। সেই শিক্ষা থেকে একুশের ভোটের অনেক আগেই জোট গড়ার জন্য মূলত উদ্যোগী হন আলিমুদ্দিন স্ট্রিটের কর্তারা। সেই উদ্যোগের সাফল্যই লাইমলাইটে নিয়ে এল পীরজাদা আব্বাস সিদ্দিকিকে। ব্রিগেডের জমায়েতে তা-ই প্রতিফলিত হল। কিন্তু ভোটের ফলে দেখা গেল, শিবরাত্রির সলতের মতো সিদ্দিকির আইএসএফ-এর মাত্র একজন বিধায়ক। বাম ও কংগ্রেস শূন্য। আর হাতে রইল ঝান্ডাতেই মোর্চার প্রাসঙ্গিকতা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে শুরু করল। শুক্রবার সাংবাদিক বৈঠকে CPIM-এর সাধারণ সম্পাদক সীতারাম ইয়েচুরি সেই জোটের ঘোঁট সাফা করে দিলেন। অধীর চৌধুরীর স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া, '২০১৬ সালে জোট হয়েছিল। আমাদের সঙ্গে আলোচনা না করে ওঁরা নিজেরা তা ভেঙে দিয়েছিলেন। ২০২১ সালে আবার জোট হল। উভয়ে হেরেছি। তাঁরা মনে করছেন, জোটের দরকার নেই। আমরা এ কথা বলিনি।' অন্য দিকে, মোর্চার একমাত্র বিধায়ক নাওশাদ সিদ্দিকির সাফ কথা, 'আমার মনে হয় যদি এটা ভাঙারই হয়, তবে সীতারাম ইয়েচুরি স্যারের মুখ থেকে নয়, বামেদের যে চেয়ারম্যান আছেন বিমান বসু, আমরা তাঁর মুখ থেকে শুনতে চাই। তিনি ঘোষণা করে দিন, সংযুক্ত মোর্চার প্রাসঙ্গিকতা আর নেই, এটা ডিজলভ করে দেওয়া হল। তাহলে বাংলার মানুষের কাছে এটা ক্লিয়ার হয়ে যাবে।' রাজনীতিতে নবীন নাওশাদের কথার মধ্যে দুটি জিনিস বেরিয়ে আসছে। এক, তাঁরা ওই সব পলিটব্যুরো দেখে মোর্চায় আসেননি। দুই, জোট রাজনীতি ছেলের হাতের মোয়া নয়, তার কিছু নৈতিক দিকও আছে।
নাওশাদ আবেগে যা-ই বলুন, বাম-কংগ্রেস-আব্বাসের জোট কতটা নীতিসম্মত, তা নিয়ে ভোটের সময়েও প্রশ্ন উঠেছিল। রাজ্য CPIM শূন্য হতেই ফল বেরোনোর সন্ধ্যায় পরাজিত বিধায়ক তন্ময় ভট্টাচার্য টিভি চ্যাটে আইএসএফ-কে নিয়ে মোর্চা করা প্রসঙ্গেই প্রশ্ন তুলে দিয়েছিলেন। তিনি নাম না করে বিঁধেছিলেন মহম্মদ সেলিমকে। পরে CPIM রাজ্য কমিটিতে কৌশল নিয়ে প্রশ্ন করেছিলেন অনেকেই। বাম শরিকদের কারও কারও দাবি ছিল, কংগ্রেস আর আইএসএফ-কে নিয়ে ভোটে লড়ার ফলেই মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন সাধারণ সমর্থকরা। তখনই জোট বা মোর্চার ভবিষ্যৎ নিয়ে দেয়াল লিখন পড়া যাচ্ছিল। জোটের ভবিষ্যৎ নিয়ে কেন্দ্রীয় কমিটির প্রশ্নের মুখেও পড়েছিলেন রাজ্যের নেতারা। সেই কেন্দ্রীয় কমিটির বৈঠকের দ্বিতীয় দিনে সীতারাম ইয়েচুরি, প্রকাশ কারাটরা সাফ জানিয়ে দেন, নির্বাচনের সময় মোর্চা গড়া সঠিক হলেও তা কখনই দীর্ঘস্থায়ী জোট হতে পারে না। যদি দীর্ঘস্থায়ী জোটের ভাবনা থাকে, তা হলে তা সঠিক হবে না। পরে রাজ্য কমিটির বৈঠকেও বঙ্গমুখী সাধারণ সম্পাদক ইয়েচুরি জোট করার আদিখ্যেতা নিয়ে কঠিন ভাষায় সমালোচনা করেন। আর গত শুক্রবার ইয়েচুরি তা পরিষ্কার করে দিলেন, ভোট শেষ, জোটও শেষ।
ইয়েচুরি বা CPIM কেন্দ্রীয় কমিটির এ দিনের বক্তব্যে আরও একবার প্রশ্ন তুলে দিল, জোট কি তবে কেবলমাত্র নির্বাচনী সাফল্যের জন্যই? এমনটা হলে তো ভবিষ্যতেও জোটের বিশ্বাসযোগ্যতা থাকবে না। রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরা স্মরণ করিয়ে দিলেন, ১৯৭৭ সালে ইন্দিরা গান্ধীকে ক্ষমতাচ্যুত করেছিল বিরোধী জোট। সে উদাহরণ দিয়ে ইয়েচুরিও এদিন বলেন, 'ইমিডিয়েট পারপাসের জন্য ফ্রন্ট তৈরি হয়। ইভেন্ট শেষ হলে পারপাস থাকে না।' তাই ৩ বছরের মধ্যেই ইন্দিরা গান্ধী ক্ষমতায় ফেরেন। আর সেটা ফেরেন বিরোধীরা জোট রাজনীতির ধর্ম বজায় রাখতে পারেন না বলেই। যে যার অ্যাজেন্ডা নিয়ে মাঠে নেমে পড়েছিলেন বলেই। এখন বাংলাতেই এই অবস্থা হলে ২০২৪ সালে সর্বভারতীয় মঞ্চে মোদী-বিরোধী জোটের কী হাল হবে? কী যে হবে, তার একটা স্পেসিমেন শুক্রবার তৃণমূলের মুখপত্রে বেরিয়ে পড়েছে। তৃণমূল দাবি করেছে, ২০১৪ ও ২০১৯ সালের ভোটে রাহুল গান্ধীকে মুখ করে বিরোধীদের পরাজয় হয়েছে। তাই রাহুল নন, ২৪-এ মোদী-বিরোধী মুখ হবেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
(এই প্রবন্ধে প্রকাশিত মতামত সম্পূর্ণ ভাবে লেখকের ব্যক্তিগত। এই সময় ডিজিটাল কোনও ভাবেই লেখার দায়ভার বহন করে না।)