প্রশান্ত ভট্টাচার্য 'আমি কংগ্রেসের পূর্ণ সময়ের সভাপতি।' ৩-G বনাম G-২৩'এর লড়াইয়ে ৩-G'কে রক্ষা করতে একটু স্বভাবের বাইরে বেরিয়ে এলেন সোনিয়া গান্ধী (Sonia Gandhi)। গত শনিবার কংগ্রেসের ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠকে যে মেজাজে রাজীব গান্ধীর স্ত্রীকে দেখা গেল, এমনটা অতীতে কংগ্রেস নেতারা তাঁকে দেখেননি। আসলে G-২৩'এর নেতা কপিল সিব্বাল, গুলাম নবি আজাদ, আনন্দ শর্মাদের সোনিয়া সমঝে দিলেন, 'রাহুল অস্থিরমতি হতে পারে, কিন্তু আমি আছি। আর গান্ধী পরিবারের ব্র্যান্ড-ইক্যুয়িটি এখনও কংগ্রেসে অক্ষত রয়েছে।
দেখতে দেখতে সোনিয়া গান্ধীর প্রত্যক্ষ রাজনীতির বয়স তিরিশ পেরিয়ে গিয়েছে। তিনি যথেষ্ট শান্ত মেজাজের। তাঁকে বিঘ্নিত হতে দেখা গিয়েছে খুবই কম। কংগ্রেস ২০০৪ সালে তাঁর নেতৃত্বে ক্ষমতায় ফিরলেও, আমরা দেখেছি 'বিবেকের ডাকে' প্রধানমন্ত্রীর কুরশি থেকে সরে দাঁড়িয়েছেন। আর প্রধানমন্ত্রী হিসেবে বাছাই করেছেন এমন একজনকে, যিনি তাঁর শিক্ষা ও সংস্কৃতি অনুযায়ী কখনও সোনিয়া গান্ধীর কর্তৃত্বকে অস্বীকার করে বিদ্রোহী হয়ে উঠতে পারবেন না। পারবেন না উপদল করতে। এই পুঁজি থাকার ফলে সোনিয়া কখনই নিজের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করতে উৎসাহ দেখাননি। তবে নেহরু-গান্ধী পরিবারের বউ হওয়ার সুবাদে দলে সোনিয়া বিশেষ মর্যাদা পেয়ে আসছেন। হয়ত সেই কারণেই তাঁকে কখনও ক্ষমতা বিস্তারের অনুশীলন করতে হয়নি। উলটোদিকে দেশজুড়ে কংগ্রেসের ক্ষমতা সংকুচিত হলেও দলে সোনিয়ার দাপট বেড়েছে। প্রায় না-থাকা UPA-র তিনি এখনও চেয়ারপার্সন। তবে সোনিয়া বরাবরই দল পরিচালনায় অন্যদের পরামর্শ নিয়েছেন। কিন্তু যেটা করার জন্য তিনি গান্ধী পরিবারের কাছে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ সেই রাজীব-তনয় রাহুল গান্ধীকে আজও দলের সর্বসম্মতিক্রম নেতা করে উঠতে পারলেন না। আর এটা পারছেন না বলেই অসুস্থ সোনিয়া মাঝে মাঝে স্বমেজাজে থাকতে পারছেন না। একজন ভারতীয় মায়ের মতো বাপ-মরা ছেলেটাকে যে একটু দাঁড় করিয়ে দিয়ে যাবেন, সে মানসিকতা সোনিয়ার তৈরি হয়ে গিয়েছে। তিনি তাই গত তিরিশ বছর ধরে কংগ্রেসকে সামলে চলেছেন। পাশে পেয়েছেন, মনমোহন সিং, এ কে অ্যান্টনি, আহমেদ প্যাটেলের মতো বিশ্বস্ত পরামর্শদাতাদের।
কিন্তু, এই অনুকূল সময়কালের মধ্যে রাহুল গান্ধী পারলেন না, নিজেকে তৈরি করে নিতে। সোনিয়া সম্ভবত ভাবেন, তিনি চোখ বুজলে পরিবারের ব্র্যান্ড-ইক্যুয়িটি ঘরে তোলার মতো আর কেউ থাকবে না। এই দুঃশ্চিন্তা থেকেই প্রিয়াঙ্কাকে রাজনীতিতে ঠেলে নামালেন। যদি সেই মেয়েটি তাঁর ঠাকুমার জেশ্চারে দলটাকে সামলাতে পারেন আর দাদা রাহুলকে রাজনীতিতে পাকাপোক্ত জায়গা করে দিতে পারেন। কিন্তু, গত তিন-চার বছরের অভিজ্ঞতায় সোনিয়া বুঝে গিয়েছেন সেটা প্রায় অনিশ্চিত। BJP-র অনবরত পরিবারতান্ত্রিক রাজনীতির গাল হজম করেও তবুও প্রিয়াঙ্কাকে মদত করে চলেছেন সোনিয়া। মোদী-শাহরা তো গত ৭ বছর ধরে অহরহ বার্তা দিয়ে যাচ্ছেন, প্রধানমন্ত্রী হওয়াটা কোনও একটা পরিবারের যে একচেটিয়া নয়, তা বহুস্বরের ভারত বুঝিয়ে দিয়েছে। তাই মোদীর নেতৃত্বে 'আত্মনির্ভর ভারত' বিকশিত হচ্ছে। এই অবস্থায় সোনিয়া গান্ধীর পক্ষে একটাই আশার কথা, BJP বিরোধী দলগুলোর মধ্যে তাঁর যে গ্রহণযোগ্যতা আছে, তা তাঁর দলের আর কারোর নেই। বিশেষ করে বিদ্রোহী G-২৩'এর কোনও নেতাই ওজনদার নয়।
আজ যদি, বিশ্বনাথ প্রতাপ সিং, মোরারজি দেশাই, দেবরাজ আরস, শরদ পাওয়ারদের মতো কোনো নেতা ওই বিদ্রোহীদের শিবিরে থাকতেন, তবে গান্ধী-নেহরু পরিবারের আধিপত্য মাটিতে মিশে যেত। ২০১৬ সালের মে-জুন মাস নাগাদ, যখন রাহুলকে কংগ্রেসের সভাপতি করার পথে এগোচ্ছিল দল তখন ছত্তিশগড়ে আলাদা দল গড়ার হুমকি দিয়েছিলেন অজিত জোগী। একসময়ে রাজীব গান্ধীর কাছের লোক মহারাষ্ট্রের গুরুদাস কামাথ ঘোষণা করেছিলেন, তিনিও কংগ্রেস ছাড়ার কথা ভাবছেন। ত্রিপুরায় কংগ্রেসের বিধায়কদের প্রায় সকলেই যোগ দিয়েছিলেন তৃণমূলে। অসমে হিমন্ত বিশ্বশর্মার মতে নেতা BJP-তে যোগ দেওয়ার পরে প্রচার করছেন যে রাহুলের দুর্ব্যবহারের জন্য তিনি দল ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন। যদিও কংগ্রেস, এটি সম্পূর্ণ অপপ্রচার বলে উড়িয়ে দিয়েছে।
বাস্তবিক রাহুলকে সভাপতি করার তোড়জোড় শুরু হতেই বিভিন্ন রাজ্যে দলের বর্ষীয়ান নেতাদের এমন পদক্ষেপ চিন্তায় ফেলে দিয়েছিল সোনিয়া গান্ধীকে। তিনি তখন পরিস্থিতি কোনোরকমে সামলে ছিলেন। আহমেদ প্যাটেলের মতো ২৪ আকবর রোডের ম্যানেজারদের নামিয়ে শেষ পর্যন্ত বছর দেড়েক বাদে রাহুলকে কংগ্রেসের সভাপতি করতে সমর্থ হন সোনিয়া গান্ধী। কিন্তু রাহুল পারলেন না। অথচ দেখার, মনমোহন সিং যে নয়া অর্থনীতি, যে খোলা বাজারের চল করেছিলেন, তাই ধরে নরেন্দ্র মোদী ঘরে ফসল তুলছেন। ইউপিএ'র ১০ বছরে যে জনমুখী প্রকল্পগুলো নেওয়া হয়েছিল, সেগুলোই নাম পালটে মোদী সরকারের USP।
অথচ কংগ্রেস এই ৭ বছরে তার থেকে কোনও ফয়দা তুলতে পারল না। রাহুল গান্ধী তিনটে জিনিস বুঝেই উঠতে পারলেন না, ১) তিনি কি সেন্টার অফ দ্য লেফট থাকবেন? ২) দলের ভিতরে বৃদ্ধতন্ত্রের বিরুদ্ধে অল আউট খেলবেন? ৩) তিনি কি সর্বসময়ের একজন রাজনীতিক হবেন? এই ত্রহস্পর্শ তাঁকে কোনও রাজনৈতিক দিশা দিতে পারছে না। অতি সম্প্রতি, তিনি দলে আনতে পেরেছেন কানহাইয়া কুমারের মতো বলিয়েকইয়ে নেতাকে। একই সঙ্গে পেয়েছেন, জিগনেশ মেভানির মতো এক নেতাকে। কিন্তু এঁদের দিয়ে ঠিক কী কী করবেন, তার কোনও স্বচ্ছ ধারণা রাহুলের নেই। যেমন নেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো একজন সেল্ফমেড লড়াকু জনপ্রিয় রাজনৈতিক নেতার সঙ্গে সম্পর্ক রক্ষা করে চলার মতো কুশলতা। একই হাল, অরবিন্দ কেজরিওয়ালের ক্ষেত্রেও। অখিলেশ যাদবও এখন দূরের নক্ষত্র। জানি না, তেজস্বী যাদবের সঙ্গে কতদিন সখ্য রাখতে পারবেন! কোয়ালিশন রাজনীতিতে এমনিতেই কংগ্রেস কমফোর্ট ফিল করে না, রাহুল তো আরও এককদম। অন্যদিকে, কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠকে সোনিয়া গান্ধীকে শুরুতেই বলে নিতে হচ্ছে, ‘আপনারা অনুমতি দিলে, আমি কংগ্রেসের পূর্ণ সময়ের সভাপতি হতে পারি। আমি বরাবরই গণতান্তিক পরিবেশে ওপর ভরসা করেছি। তাই সংবাদমাধ্যমের বিবৃতির মাধ্যমে আমার সঙ্গে কথা বলার কী প্রয়োজন? আসুন সবাই মিলে খোলামেলা আলোচনা করি। যা সিদ্ধান্ত হবে তা এই চার দেওয়ালের বাইরে কর্মসমিতির সিদ্ধান্ত বলেই বিবেচিত হবে।’
কখন সোনিয়াকে এই কথা বলতে হচ্ছে, যখন আগামী বছরই দেশের বৃহত্তম রাজ্য উত্তরপ্রদেশ-সহ পঞ্জাব, গোয়া, হিমাচল প্রদেশ, উত্তরাখণ্ড, মণিপুর ও গুজরাতের মতো রাজ্যে বিধানসভা নির্বাচন। আর তার প্রাক্কালে এসব কথা বলে সোনিয়া কোন জগদ্দলকে সরাবেন? এই রাজ্যগুলোর মধ্যে ফল অনুকূলে না গেলেও কংগ্রেসের একার জোরে লড়ার মতো ক্ষমতা আছে পঞ্জাব, গুজরাত, উত্তরাখণ্ড ও হিমাচল প্রদেশে। গোয়ার হাল সুবিধার নয়। লুইজিনহো ফালেরিও কংগ্রেস ছেড়ে তৃণমূলে। উত্তরপ্রদেশের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী তথা প্রাক্তন রেলমন্ত্রী কমলাপতি ত্রিপাঠীর প্রপৌত্র ললিতেশও তৃণমূলে যোগ দিতে পারেন বলে শোনা যাচ্ছে। প্রিয়াঙ্কার আস্থাভাজন বলে পরিচিত ললিতেশ ত্রিপাঠী তৃণমূলে যোগ দিলে তা গান্ধী পরিবারের পক্ষে অস্বস্তির বিষয় হয়ে উঠবে। ললিতেশ উত্তরপ্রদেশ কংগ্রেসের সহ-সভাপতি ছিলেন। তিনি পূর্ব উত্তরপ্রদেশে কংগ্রেসের অন্যতম ব্রাহ্মণ মুখ হিসেবে পরিচিত। কয়েকদিন আগে তিনি পদত্যাগ করেন। এখন তৃণমূলে যোগ দিলে তৃণমূলের হয়ত কিছুই লাভ হবে না কিন্তু কংগ্রেসের ক্ষতি হবে। তাই চিন্তা বাড়ছে কংগ্রেসের। অন্যদিকে, রাহুলের অবিমৃষ্যকারিতায় ক্যাপ্টেন অমরিন্দর সিং প্রায় দলছুট। শোনা যাচ্ছে, তিনি নতুন দল তৈরি করে আগামী বিধানসভা নির্বাচনে BJP-র সঙ্গে আসন রফা করবেন। ফলে পঞ্চ নদীর তীরেও কংগ্রেসের পক্ষে সুপবন বহিতেছে না। এই অবস্থায় কংগ্রেসে নেই কোনও ক্যারিশ্ম্যাটিক নেতা, না আছে বিকল্প কোনও রাজনীতি। স্বাভাবিকভাবে সোনিয়া গান্ধী আর কতদিন সামাল দেবেন।
(এই প্রবন্ধে প্রকাশিত মতামত সম্পূর্ণ ভাবে লেখকের ব্যক্তিগত। এই সময় ডিজিটাল কোনও ভাবেই লেখার দায়ভার বহন করে না।)
দেখতে দেখতে সোনিয়া গান্ধীর প্রত্যক্ষ রাজনীতির বয়স তিরিশ পেরিয়ে গিয়েছে। তিনি যথেষ্ট শান্ত মেজাজের। তাঁকে বিঘ্নিত হতে দেখা গিয়েছে খুবই কম। কংগ্রেস ২০০৪ সালে তাঁর নেতৃত্বে ক্ষমতায় ফিরলেও, আমরা দেখেছি 'বিবেকের ডাকে' প্রধানমন্ত্রীর কুরশি থেকে সরে দাঁড়িয়েছেন। আর প্রধানমন্ত্রী হিসেবে বাছাই করেছেন এমন একজনকে, যিনি তাঁর শিক্ষা ও সংস্কৃতি অনুযায়ী কখনও সোনিয়া গান্ধীর কর্তৃত্বকে অস্বীকার করে বিদ্রোহী হয়ে উঠতে পারবেন না। পারবেন না উপদল করতে। এই পুঁজি থাকার ফলে সোনিয়া কখনই নিজের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করতে উৎসাহ দেখাননি। তবে নেহরু-গান্ধী পরিবারের বউ হওয়ার সুবাদে দলে সোনিয়া বিশেষ মর্যাদা পেয়ে আসছেন। হয়ত সেই কারণেই তাঁকে কখনও ক্ষমতা বিস্তারের অনুশীলন করতে হয়নি। উলটোদিকে দেশজুড়ে কংগ্রেসের ক্ষমতা সংকুচিত হলেও দলে সোনিয়ার দাপট বেড়েছে। প্রায় না-থাকা UPA-র তিনি এখনও চেয়ারপার্সন। তবে সোনিয়া বরাবরই দল পরিচালনায় অন্যদের পরামর্শ নিয়েছেন। কিন্তু যেটা করার জন্য তিনি গান্ধী পরিবারের কাছে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ সেই রাজীব-তনয় রাহুল গান্ধীকে আজও দলের সর্বসম্মতিক্রম নেতা করে উঠতে পারলেন না। আর এটা পারছেন না বলেই অসুস্থ সোনিয়া মাঝে মাঝে স্বমেজাজে থাকতে পারছেন না। একজন ভারতীয় মায়ের মতো বাপ-মরা ছেলেটাকে যে একটু দাঁড় করিয়ে দিয়ে যাবেন, সে মানসিকতা সোনিয়ার তৈরি হয়ে গিয়েছে। তিনি তাই গত তিরিশ বছর ধরে কংগ্রেসকে সামলে চলেছেন। পাশে পেয়েছেন, মনমোহন সিং, এ কে অ্যান্টনি, আহমেদ প্যাটেলের মতো বিশ্বস্ত পরামর্শদাতাদের।
কিন্তু, এই অনুকূল সময়কালের মধ্যে রাহুল গান্ধী পারলেন না, নিজেকে তৈরি করে নিতে। সোনিয়া সম্ভবত ভাবেন, তিনি চোখ বুজলে পরিবারের ব্র্যান্ড-ইক্যুয়িটি ঘরে তোলার মতো আর কেউ থাকবে না। এই দুঃশ্চিন্তা থেকেই প্রিয়াঙ্কাকে রাজনীতিতে ঠেলে নামালেন। যদি সেই মেয়েটি তাঁর ঠাকুমার জেশ্চারে দলটাকে সামলাতে পারেন আর দাদা রাহুলকে রাজনীতিতে পাকাপোক্ত জায়গা করে দিতে পারেন। কিন্তু, গত তিন-চার বছরের অভিজ্ঞতায় সোনিয়া বুঝে গিয়েছেন সেটা প্রায় অনিশ্চিত। BJP-র অনবরত পরিবারতান্ত্রিক রাজনীতির গাল হজম করেও তবুও প্রিয়াঙ্কাকে মদত করে চলেছেন সোনিয়া। মোদী-শাহরা তো গত ৭ বছর ধরে অহরহ বার্তা দিয়ে যাচ্ছেন, প্রধানমন্ত্রী হওয়াটা কোনও একটা পরিবারের যে একচেটিয়া নয়, তা বহুস্বরের ভারত বুঝিয়ে দিয়েছে। তাই মোদীর নেতৃত্বে 'আত্মনির্ভর ভারত' বিকশিত হচ্ছে। এই অবস্থায় সোনিয়া গান্ধীর পক্ষে একটাই আশার কথা, BJP বিরোধী দলগুলোর মধ্যে তাঁর যে গ্রহণযোগ্যতা আছে, তা তাঁর দলের আর কারোর নেই। বিশেষ করে বিদ্রোহী G-২৩'এর কোনও নেতাই ওজনদার নয়।
আজ যদি, বিশ্বনাথ প্রতাপ সিং, মোরারজি দেশাই, দেবরাজ আরস, শরদ পাওয়ারদের মতো কোনো নেতা ওই বিদ্রোহীদের শিবিরে থাকতেন, তবে গান্ধী-নেহরু পরিবারের আধিপত্য মাটিতে মিশে যেত। ২০১৬ সালের মে-জুন মাস নাগাদ, যখন রাহুলকে কংগ্রেসের সভাপতি করার পথে এগোচ্ছিল দল তখন ছত্তিশগড়ে আলাদা দল গড়ার হুমকি দিয়েছিলেন অজিত জোগী। একসময়ে রাজীব গান্ধীর কাছের লোক মহারাষ্ট্রের গুরুদাস কামাথ ঘোষণা করেছিলেন, তিনিও কংগ্রেস ছাড়ার কথা ভাবছেন। ত্রিপুরায় কংগ্রেসের বিধায়কদের প্রায় সকলেই যোগ দিয়েছিলেন তৃণমূলে। অসমে হিমন্ত বিশ্বশর্মার মতে নেতা BJP-তে যোগ দেওয়ার পরে প্রচার করছেন যে রাহুলের দুর্ব্যবহারের জন্য তিনি দল ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন। যদিও কংগ্রেস, এটি সম্পূর্ণ অপপ্রচার বলে উড়িয়ে দিয়েছে।
বাস্তবিক রাহুলকে সভাপতি করার তোড়জোড় শুরু হতেই বিভিন্ন রাজ্যে দলের বর্ষীয়ান নেতাদের এমন পদক্ষেপ চিন্তায় ফেলে দিয়েছিল সোনিয়া গান্ধীকে। তিনি তখন পরিস্থিতি কোনোরকমে সামলে ছিলেন। আহমেদ প্যাটেলের মতো ২৪ আকবর রোডের ম্যানেজারদের নামিয়ে শেষ পর্যন্ত বছর দেড়েক বাদে রাহুলকে কংগ্রেসের সভাপতি করতে সমর্থ হন সোনিয়া গান্ধী। কিন্তু রাহুল পারলেন না। অথচ দেখার, মনমোহন সিং যে নয়া অর্থনীতি, যে খোলা বাজারের চল করেছিলেন, তাই ধরে নরেন্দ্র মোদী ঘরে ফসল তুলছেন। ইউপিএ'র ১০ বছরে যে জনমুখী প্রকল্পগুলো নেওয়া হয়েছিল, সেগুলোই নাম পালটে মোদী সরকারের USP।
অথচ কংগ্রেস এই ৭ বছরে তার থেকে কোনও ফয়দা তুলতে পারল না। রাহুল গান্ধী তিনটে জিনিস বুঝেই উঠতে পারলেন না, ১) তিনি কি সেন্টার অফ দ্য লেফট থাকবেন? ২) দলের ভিতরে বৃদ্ধতন্ত্রের বিরুদ্ধে অল আউট খেলবেন? ৩) তিনি কি সর্বসময়ের একজন রাজনীতিক হবেন? এই ত্রহস্পর্শ তাঁকে কোনও রাজনৈতিক দিশা দিতে পারছে না। অতি সম্প্রতি, তিনি দলে আনতে পেরেছেন কানহাইয়া কুমারের মতো বলিয়েকইয়ে নেতাকে। একই সঙ্গে পেয়েছেন, জিগনেশ মেভানির মতো এক নেতাকে। কিন্তু এঁদের দিয়ে ঠিক কী কী করবেন, তার কোনও স্বচ্ছ ধারণা রাহুলের নেই। যেমন নেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো একজন সেল্ফমেড লড়াকু জনপ্রিয় রাজনৈতিক নেতার সঙ্গে সম্পর্ক রক্ষা করে চলার মতো কুশলতা। একই হাল, অরবিন্দ কেজরিওয়ালের ক্ষেত্রেও। অখিলেশ যাদবও এখন দূরের নক্ষত্র। জানি না, তেজস্বী যাদবের সঙ্গে কতদিন সখ্য রাখতে পারবেন! কোয়ালিশন রাজনীতিতে এমনিতেই কংগ্রেস কমফোর্ট ফিল করে না, রাহুল তো আরও এককদম। অন্যদিকে, কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠকে সোনিয়া গান্ধীকে শুরুতেই বলে নিতে হচ্ছে, ‘আপনারা অনুমতি দিলে, আমি কংগ্রেসের পূর্ণ সময়ের সভাপতি হতে পারি। আমি বরাবরই গণতান্তিক পরিবেশে ওপর ভরসা করেছি। তাই সংবাদমাধ্যমের বিবৃতির মাধ্যমে আমার সঙ্গে কথা বলার কী প্রয়োজন? আসুন সবাই মিলে খোলামেলা আলোচনা করি। যা সিদ্ধান্ত হবে তা এই চার দেওয়ালের বাইরে কর্মসমিতির সিদ্ধান্ত বলেই বিবেচিত হবে।’
কখন সোনিয়াকে এই কথা বলতে হচ্ছে, যখন আগামী বছরই দেশের বৃহত্তম রাজ্য উত্তরপ্রদেশ-সহ পঞ্জাব, গোয়া, হিমাচল প্রদেশ, উত্তরাখণ্ড, মণিপুর ও গুজরাতের মতো রাজ্যে বিধানসভা নির্বাচন। আর তার প্রাক্কালে এসব কথা বলে সোনিয়া কোন জগদ্দলকে সরাবেন? এই রাজ্যগুলোর মধ্যে ফল অনুকূলে না গেলেও কংগ্রেসের একার জোরে লড়ার মতো ক্ষমতা আছে পঞ্জাব, গুজরাত, উত্তরাখণ্ড ও হিমাচল প্রদেশে। গোয়ার হাল সুবিধার নয়। লুইজিনহো ফালেরিও কংগ্রেস ছেড়ে তৃণমূলে। উত্তরপ্রদেশের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী তথা প্রাক্তন রেলমন্ত্রী কমলাপতি ত্রিপাঠীর প্রপৌত্র ললিতেশও তৃণমূলে যোগ দিতে পারেন বলে শোনা যাচ্ছে। প্রিয়াঙ্কার আস্থাভাজন বলে পরিচিত ললিতেশ ত্রিপাঠী তৃণমূলে যোগ দিলে তা গান্ধী পরিবারের পক্ষে অস্বস্তির বিষয় হয়ে উঠবে। ললিতেশ উত্তরপ্রদেশ কংগ্রেসের সহ-সভাপতি ছিলেন। তিনি পূর্ব উত্তরপ্রদেশে কংগ্রেসের অন্যতম ব্রাহ্মণ মুখ হিসেবে পরিচিত। কয়েকদিন আগে তিনি পদত্যাগ করেন। এখন তৃণমূলে যোগ দিলে তৃণমূলের হয়ত কিছুই লাভ হবে না কিন্তু কংগ্রেসের ক্ষতি হবে। তাই চিন্তা বাড়ছে কংগ্রেসের। অন্যদিকে, রাহুলের অবিমৃষ্যকারিতায় ক্যাপ্টেন অমরিন্দর সিং প্রায় দলছুট। শোনা যাচ্ছে, তিনি নতুন দল তৈরি করে আগামী বিধানসভা নির্বাচনে BJP-র সঙ্গে আসন রফা করবেন। ফলে পঞ্চ নদীর তীরেও কংগ্রেসের পক্ষে সুপবন বহিতেছে না। এই অবস্থায় কংগ্রেসে নেই কোনও ক্যারিশ্ম্যাটিক নেতা, না আছে বিকল্প কোনও রাজনীতি। স্বাভাবিকভাবে সোনিয়া গান্ধী আর কতদিন সামাল দেবেন।
(এই প্রবন্ধে প্রকাশিত মতামত সম্পূর্ণ ভাবে লেখকের ব্যক্তিগত। এই সময় ডিজিটাল কোনও ভাবেই লেখার দায়ভার বহন করে না।)