পরিবেশকে উপেক্ষা করলে কী হতে পারে, তেমন বিপর্যয়ের দৃষ্টান্ত অজস্র। সরকারি নথিপত্রে এবং গবেষণায় তা স্বীকৃতও। তবু কোথাও কারও হুঁশ ফিরল না। লিখছেন ধ্রুবজ্যোতি ঘোষ।
দু’টি আলাদা গোলার্ধ, অথচ সুস্পষ্ট সাদৃশ্য৷ জলাভূমি এবং সবুজ ধ্বংস করা , প্রশাসনিক অকর্মণ্যতা এবং প্রতিরোধের ক্ষমতা হারানো অসম সমাজ৷ কেন হিউস্টনে হারিকেন হার্ভের দাপটে বিপর্যস্ত নাগরিক জীবন আর বানভাসি মুম্বইয়ের একই ছবি ? এর উত্তর সাজিয়েছেন বিজ্ঞানীরা৷ ৬৫ বর্গমাইল জলাভূমি বুজিয়ে ফেলা হয়েছে হিউস্টন -গ্যালভেস্টন উপসাগরীয় অঞ্চলে৷ আবার হ্যারিস কাউন্টির শতকরা ৩০ ভাগ জমি বাঁধানো হয়ে গিয়েছে যাতে জল না নীচে যেতে পারে৷ উনিশ শতকের গোড়ার দিকে যে বিশাল জলাভূমি ছিল মুম্বই শহরকে ঘিরে , আজ তা প্রায় সম্পূর্ণ নিশ্চিহ্ন৷ ২০০৫ -এর বন্যায় অন্তত ১০০০ মানুষ প্রাণ হারিয়েছিলেন আর ক্ষতি হয়েছিল ৫৫০ কোটি টাকার৷ এর পরেও কিন্ত্ত অবস্থার কোনও মৌলিক পরিবর্তন হয়নি৷ জলাভূমি বুজবে , সবুজ কমবে , অসাম্য বাড়বে , আরও অনেক মানুষ বানভাসি হবেন৷ তবু উন্নয়ন হবে৷ শহর চৌকস হবে৷
জলাঞ্জলি ইকোলজিআমি যে বিষয়বস্ত্ত নিয়ে কাজ করি , শেখার চেষ্টা করি , তার নাম হল ইকোলজি৷ ইকোলজির উপযুক্ত বাংলা নেই৷
ফলিডলের বাংলা হয় না , পুলিশেরও বাংলা হয় না৷ এতে কিছু যায় আসে না৷ কিন্ত্ত বিষয়বস্ত্তটির মূল দায়িত্ব হল প্রকৃতি আর মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করা৷ ছড়ানো ছেটানো বিন্দুগুলিকে এক সূত্রে যুক্ত করা৷ তাই আমাদের থাকবার জায়গাটায় , আমাদের পৃথিবীটাতে কী ভাবে প্রকৃতির সঙ্গে একটার পর একটা সম্পর্ক বজায় রাখার নিয়মকানুনগুলিকে মনুষ্যসমাজ বাতিল করছে এটা দেখা , এটা বোঝাতে চেষ্টা করা , সকলকে জানানো এবং পারলে বাধা দেওয়া যে কোনও ইকোলজির ছাত্র -ছাত্রীর প্রাথমিক কর্মকাণ্ড৷
যা করা ঠিক নয় , বারবার গুরুতর শিক্ষা পাবার পরেও কী নিরুত্তাপ ধারাবাহিকতায় সারা পৃথিবী জুড়ে ইকোলজির সেই প্রথম পাঠগুলি পা দিয়ে মাড়িয়ে আমাদের সভ্যতা এগোবার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে , তা দেখলে শিউরে উঠতে হয়৷ হাজার হাজার দৃষ্টান্ত আছে , প্রচুর লেখা আছে কিন্ত্ত সেই সব নস্যাত্ করে উন্নয়ন তথা পুঁজি বাড়ানোর কারখানা চব্বিশ ঘণ্টা চলছে৷ থামছে না৷
হারিকেন হার্ভে সুনামির মতো না -জানা দুর্যোগ নয়৷ এ রকম হারিকেন আগেও হয়েছে , বস্ত্তত এর থেকে অনেক ভয়াবহ হারিকেন হয়েছে পৃথিবীর ইতিহাসে৷ তার এবারকার আলোচনা যতটা জলবায়ু বিজ্ঞান নিয়ে , তার থেকে অনেক বেশি ক্ষয়ক্ষতি নিয়ে৷ সবাই যেন প্রকৃতি আর মানুষের সম্পর্কের প্রাথমিক শর্তগুলো মানতে বড়ই অপারগ৷ তফাত্ যাও ইকোলজি৷ তুমি আবার কোথা থেকে উড়ে এসে জুড়ে বসলে ? অথচ এই ইকোলজির প্রথম ভাগের পাঠগুলিকে বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ দেখিয়ে পৃথিবীর ধনীতম দেশ দাপট দেখাতে গিয়ে কলার খোসায় আছাড় খেলেন৷ বিশ্বাস করুন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প --- ইকোলজি না শিখলে , না বুঝলে , আপনার দিন ঘনিয়ে এসেছে৷
কী হল টেক্সাসে ? নির্দ্বিধায় উপকূল দখল হল বসতি বসাতে , জলাভূমি বুজে গেল ফ্ল্যাটবাড়ি আর বাংলোতে৷ একেবারে ভারতীয় তটবর্তী কর্মসূচির কপি -পেস্ট৷
শহর গরম হোকস্মার্ট সিটি না বলে হট সিটি বললে কি খারাপ শোনাত ? অথচ কাজটা অনেক সোজা হয়ে যেত৷ বস্ত্তত আমরা ‘হট সিটি ’ প্রকল্পে নেমে পড়েছি৷ যা যা দরকার তা খুব মনোযোগ দিয়েই করছি৷ এর প্রথম কাজ হল গাছ কেটে ফেলা৷ তার পর সবুজ জমি না রাখা৷ যত বেশি বাড়ি করা যায় , করে ফেলা , তাতে লোক থাকুক না থাকুক পরোয়া নেই৷ সবার উপরে জলাভূমি বুজিয়ে ফেলা৷ সৌখিন কিছু জলাধার থাকবে , বাঁধানো সুইমিং পুল থাকবে , কিন্ত্ত জলাভূমি সমস্ত বুজিয়ে ফেল৷ এটা একটা জগত্জোড়া উন্নয়নের থিওরেম৷ আসুন আমরা শহরগুলোকে গরম করে ফেলি৷ ‘লেট আস মেক আওয়ার সিটিজ হট ’৷ খারাপ শোনাচ্ছে ?ডাক দিই চাই না দিই , কাজটা আমরা করেই ফেলছি৷ যেমন ধরুন কলকাতা৷ এ নিয়ে আবহাওয়া দন্তর আর অ্যালাব্যামা বিশ্ববিদ্যালয় গবেষণাও করেছেন৷ ১৯৯৬ থেকে ২০১১ -র মধ্যে গাড়ির সংখ্যা দ্বিগুণ হয়েছিল৷ ২০২৫ -এর মধ্যে আরও ৬০ লক্ষ লোক বসবাস করবেন৷ গাড়ির এসি আর বাড়ির এসির জোড়া ধাক্কায় শহর আরও কত গরম হয়ে গেছে৷ পরিবেশচর্চাকে মৌখিক তারিফ জানানো , এমনকী সাজগোজ করে আইন এবং সরকারি তত্পরতার যাবতীয় সরঞ্জাম সাজানো আছে দেশে দেশে৷ সাদাসিধে নাগরিক অধোবদন মুগ্ধ হন সরকারি তত্পরতায়৷ কিন্ত্ত শাক দিয়ে বেশি দিন মাছ ঢাকা যায় না৷ ইকোলজির মৌলিক নীতিগুলি স্কুলপাঠ্য হলে বাচ্চাগুলো গড়ে উঠত মানুষ হয়ে৷ এমনকী উচ্চতম আদালতের নির্দেশে পাঠক্রমও ঠিক করে দেওয়া হয়েছে ভারতজুড়ে৷ টাকার গায়ে গান্ধীর মাথা ছেপে দেশে শান্তি স্থাপন হচ্ছে৷ রাম -রহিমদের হাতযশ বাড়ছে৷
অথচ ঠারেঠোরে ইকোলজির কোনও জায়গা নেই প্রশাসনের তত্পরতায়৷ ধরা যাক , উপকূল বা নদীর ধার৷ চোখের সামনে ছোটো বড়ো প্রায় সব ক’টা নদীর প্লাবনভূমি দখল হয়ে যাচ্ছে দোকানপাট আর বসতবাড়িতে৷ ঠিক যেমন দিঘার উপকূলে৷ এ বলে আমায় দেখ , ও বলে আমায় দেখ৷ একটুও কম যায়নি বড়োলোকের শহর মুম্বইতে৷ সব থেকে বেশি তাচ্ছিল্য করা হয় পরিবেশের নিয়মকানুন আর ইকোলজির উপলব্ধিতে৷ ফল হাতে নাতে৷ কিন্ত্ত একচুল পাল্টাল না এই ইচ্ছামৃত্যুর প্রবণতা৷ এমনই মজা পুঁজিবাদী বুনিয়াদের৷
দ্বৈত প্রশাসনিক ব্যবস্থাইকোলজির ছাত্র হিসেবে আমাদের মূল কাজ হল ছড়ানো ছেটানো বিন্দুগুলি জোড়ার৷ আজ থেকে ৩৫ বছর আগে এই ভাবেই খুঁজে পেয়েছিলাম পূর্ব কলকাতার জলাভূমির অসামান্য অস্তিত্ব৷ আজ রাষ্ট্রপুঞ্জও সর্বশ্রেষ্ঠের স্বীকৃতি দিয়েছে এই জলাভূমিকে৷ এই জোড়া দেওয়াই আমাদের কাজ৷
খুঁজতে খুঁজতে মনে হল একটি নতুন ধরনের প্রশাসনিক বোঝাপড়া যেন কাজ করতে শুরু করেছে৷ এবং বেশ শক্তপোক্ত শিকড়ও গজিয়েছে৷ এই মুহূর্তে এই বোঝাপড়াকে আমি ‘দ্বৈত প্রশাসনিক ব্যবস্থা ’ বলতে পারি৷ যেমন ধরুন , গড়িয়াহাট মোড় , রাধাবাজার বা ধর্মতলা৷ এই সমস্ত জায়গায় হকারদের অধিকার স্বীকৃত৷ এদের পরিচালিত করেন এলাকার রাজনৈতিক শক্তি৷ শুধু তাই নয় , এখন নকশা -টালি দিয়ে ফুটপাথ বাঁধানোর ধুম পড়েছে৷ ভালো কথা৷ তবে ওই জায়গা দিয়ে বৃষ্টির যে জল মাটির নীচে ঢুকত, তা আর ঢোকে না৷ সে কথা জানান দিচ্ছে রাস্তা ভাসিয়ে , অল্প বৃষ্টিতেই৷ এগুলো কিন্ত্ত আমরা জানতাম না তা নয়৷ এখানেই শেষ নয়৷ ওই বাঁধানো ফুটপাথে দ্রুত দখল নিচ্ছেন নতুন দোকানি বা একটু এগিয়ে নেওয়া পুরনো দোকানটাই৷ ফুটপাথ বেচাকেনার জন্য৷ হাঁটার জন্য তো রাস্তা আছেই৷
ভালো দৃষ্টান্ত পূর্ব কলকাতার জলাভূমিতে৷ এখানে বেআইনি ভাবে কারা বাড়ি করবেন এই পুরো সিদ্ধান্তটাই রাজনৈতিক শক্তির দখলে৷ ঠিক যেমন ফুটপাথে কোন হকার কত দিয়ে বসবেন তা সমস্তটাই রাজনৈতিক শক্তির দখলে৷ পূর্ব কলকাতার জলা এলাকায় যে প্যাকেজটা চলে তার নাম ‘জলা ভরো , বাড়ি করো ’৷ দায়িত্বে এলাকার রাজনৈতিক পেশিশক্তি৷ ২০০২ সালে এখানকার একটা মৌজায় ৮৮ % জলা ছিল , ২০১৬ -তে কমে ১৯ % হয়েছে৷ কাজ চলছে৷ এই দখলদারির চত্বরটা নেহাত ছোটো নয়৷ অথচ দখলদারিটি মোটামুটি প্রতিষ্ঠিত৷ ভূমির উপযুক্ত ব্যবহারের ক্ষেত্রে সারা ভারতে একটি দ্বৈত প্রশাসনিক ব্যবস্থা নিঃশব্দে চালু আছে৷ অধিকাংশ ক্ষেত্রে প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের সম্পর্কের যে জোর , মানুষের টিকে থাকার যে শর্ত, এই দ্বৈত প্রশাসনিক ব্যবস্থা তার মূলে কুঠারাঘাত করে৷ এটা কতটা গুরুত্বপূর্ণ উপলব্ধি , ভবিষ্যত্ তার প্রমাণ রাখবে নিশ্চয়৷
লেখক আইএউসিএন -এর বিশেষ উপদেষ্টাপরিবেশকে উপেক্ষা করলে কী হতে পারে , তেমন বিপর্যয়ের দৃষ্টান্ত অজস্র৷ সরকারি নথিপত্রে এবং গবেষণায় তা স্বীকৃতও৷ তবুও কোথাও কারও হুঁশ ফিরল না৷ লিখছেন ধ্রুবজ্যোতি ঘোষঅজিত নাইনানস্মার্ট সিটি না বলে হট সিটি বললে কি খারাপ শোনাত ? বস্ত্তত আমরা ‘হট সিটি ’ প্রকল্পে নেমে পড়েছি৷ এর প্রথম কাজ হল গাছ কেটে ফেলা৷ তার পর সবুজ জমি না রাখা৷ যত বেশি বাড়ি করা যায় , করে ফেলা , তাতে লোক থাকুক না থাকুক পরোয়া নেই৷ সবার উপরে জলাভূমি বুজিয়ে ফেলা৷ সৌখিন কিছু জলাধার থাকবে , বাঁধানো সুইমিং পুল থাকবে , কিন্ত্ত জলাভূমি সমস্ত বুজিয়ে ফেলো৷
দু’টি আলাদা গোলার্ধ, অথচ সুস্পষ্ট সাদৃশ্য৷ জলাভূমি এবং সবুজ ধ্বংস করা , প্রশাসনিক অকর্মণ্যতা এবং প্রতিরোধের ক্ষমতা হারানো অসম সমাজ৷ কেন হিউস্টনে হারিকেন হার্ভের দাপটে বিপর্যস্ত নাগরিক জীবন আর বানভাসি মুম্বইয়ের একই ছবি ? এর উত্তর সাজিয়েছেন বিজ্ঞানীরা৷ ৬৫ বর্গমাইল জলাভূমি বুজিয়ে ফেলা হয়েছে হিউস্টন -গ্যালভেস্টন উপসাগরীয় অঞ্চলে৷ আবার হ্যারিস কাউন্টির শতকরা ৩০ ভাগ জমি বাঁধানো হয়ে গিয়েছে যাতে জল না নীচে যেতে পারে৷ উনিশ শতকের গোড়ার দিকে যে বিশাল জলাভূমি ছিল মুম্বই শহরকে ঘিরে , আজ তা প্রায় সম্পূর্ণ নিশ্চিহ্ন৷ ২০০৫ -এর বন্যায় অন্তত ১০০০ মানুষ প্রাণ হারিয়েছিলেন আর ক্ষতি হয়েছিল ৫৫০ কোটি টাকার৷ এর পরেও কিন্ত্ত অবস্থার কোনও মৌলিক পরিবর্তন হয়নি৷ জলাভূমি বুজবে , সবুজ কমবে , অসাম্য বাড়বে , আরও অনেক মানুষ বানভাসি হবেন৷ তবু উন্নয়ন হবে৷ শহর চৌকস হবে৷
জলাঞ্জলি ইকোলজিআমি যে বিষয়বস্ত্ত নিয়ে কাজ করি , শেখার চেষ্টা করি , তার নাম হল ইকোলজি৷ ইকোলজির উপযুক্ত বাংলা নেই৷
ফলিডলের বাংলা হয় না , পুলিশেরও বাংলা হয় না৷ এতে কিছু যায় আসে না৷ কিন্ত্ত বিষয়বস্ত্তটির মূল দায়িত্ব হল প্রকৃতি আর মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করা৷ ছড়ানো ছেটানো বিন্দুগুলিকে এক সূত্রে যুক্ত করা৷ তাই আমাদের থাকবার জায়গাটায় , আমাদের পৃথিবীটাতে কী ভাবে প্রকৃতির সঙ্গে একটার পর একটা সম্পর্ক বজায় রাখার নিয়মকানুনগুলিকে মনুষ্যসমাজ বাতিল করছে এটা দেখা , এটা বোঝাতে চেষ্টা করা , সকলকে জানানো এবং পারলে বাধা দেওয়া যে কোনও ইকোলজির ছাত্র -ছাত্রীর প্রাথমিক কর্মকাণ্ড৷
যা করা ঠিক নয় , বারবার গুরুতর শিক্ষা পাবার পরেও কী নিরুত্তাপ ধারাবাহিকতায় সারা পৃথিবী জুড়ে ইকোলজির সেই প্রথম পাঠগুলি পা দিয়ে মাড়িয়ে আমাদের সভ্যতা এগোবার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে , তা দেখলে শিউরে উঠতে হয়৷ হাজার হাজার দৃষ্টান্ত আছে , প্রচুর লেখা আছে কিন্ত্ত সেই সব নস্যাত্ করে উন্নয়ন তথা পুঁজি বাড়ানোর কারখানা চব্বিশ ঘণ্টা চলছে৷ থামছে না৷
হারিকেন হার্ভে সুনামির মতো না -জানা দুর্যোগ নয়৷ এ রকম হারিকেন আগেও হয়েছে , বস্ত্তত এর থেকে অনেক ভয়াবহ হারিকেন হয়েছে পৃথিবীর ইতিহাসে৷ তার এবারকার আলোচনা যতটা জলবায়ু বিজ্ঞান নিয়ে , তার থেকে অনেক বেশি ক্ষয়ক্ষতি নিয়ে৷ সবাই যেন প্রকৃতি আর মানুষের সম্পর্কের প্রাথমিক শর্তগুলো মানতে বড়ই অপারগ৷ তফাত্ যাও ইকোলজি৷ তুমি আবার কোথা থেকে উড়ে এসে জুড়ে বসলে ? অথচ এই ইকোলজির প্রথম ভাগের পাঠগুলিকে বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ দেখিয়ে পৃথিবীর ধনীতম দেশ দাপট দেখাতে গিয়ে কলার খোসায় আছাড় খেলেন৷ বিশ্বাস করুন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প --- ইকোলজি না শিখলে , না বুঝলে , আপনার দিন ঘনিয়ে এসেছে৷
কী হল টেক্সাসে ? নির্দ্বিধায় উপকূল দখল হল বসতি বসাতে , জলাভূমি বুজে গেল ফ্ল্যাটবাড়ি আর বাংলোতে৷ একেবারে ভারতীয় তটবর্তী কর্মসূচির কপি -পেস্ট৷
শহর গরম হোকস্মার্ট সিটি না বলে হট সিটি বললে কি খারাপ শোনাত ? অথচ কাজটা অনেক সোজা হয়ে যেত৷ বস্ত্তত আমরা ‘হট সিটি ’ প্রকল্পে নেমে পড়েছি৷ যা যা দরকার তা খুব মনোযোগ দিয়েই করছি৷ এর প্রথম কাজ হল গাছ কেটে ফেলা৷ তার পর সবুজ জমি না রাখা৷ যত বেশি বাড়ি করা যায় , করে ফেলা , তাতে লোক থাকুক না থাকুক পরোয়া নেই৷ সবার উপরে জলাভূমি বুজিয়ে ফেলা৷ সৌখিন কিছু জলাধার থাকবে , বাঁধানো সুইমিং পুল থাকবে , কিন্ত্ত জলাভূমি সমস্ত বুজিয়ে ফেল৷ এটা একটা জগত্জোড়া উন্নয়নের থিওরেম৷ আসুন আমরা শহরগুলোকে গরম করে ফেলি৷ ‘লেট আস মেক আওয়ার সিটিজ হট ’৷ খারাপ শোনাচ্ছে ?ডাক দিই চাই না দিই , কাজটা আমরা করেই ফেলছি৷ যেমন ধরুন কলকাতা৷ এ নিয়ে আবহাওয়া দন্তর আর অ্যালাব্যামা বিশ্ববিদ্যালয় গবেষণাও করেছেন৷ ১৯৯৬ থেকে ২০১১ -র মধ্যে গাড়ির সংখ্যা দ্বিগুণ হয়েছিল৷ ২০২৫ -এর মধ্যে আরও ৬০ লক্ষ লোক বসবাস করবেন৷ গাড়ির এসি আর বাড়ির এসির জোড়া ধাক্কায় শহর আরও কত গরম হয়ে গেছে৷ পরিবেশচর্চাকে মৌখিক তারিফ জানানো , এমনকী সাজগোজ করে আইন এবং সরকারি তত্পরতার যাবতীয় সরঞ্জাম সাজানো আছে দেশে দেশে৷ সাদাসিধে নাগরিক অধোবদন মুগ্ধ হন সরকারি তত্পরতায়৷ কিন্ত্ত শাক দিয়ে বেশি দিন মাছ ঢাকা যায় না৷ ইকোলজির মৌলিক নীতিগুলি স্কুলপাঠ্য হলে বাচ্চাগুলো গড়ে উঠত মানুষ হয়ে৷ এমনকী উচ্চতম আদালতের নির্দেশে পাঠক্রমও ঠিক করে দেওয়া হয়েছে ভারতজুড়ে৷ টাকার গায়ে গান্ধীর মাথা ছেপে দেশে শান্তি স্থাপন হচ্ছে৷ রাম -রহিমদের হাতযশ বাড়ছে৷
অথচ ঠারেঠোরে ইকোলজির কোনও জায়গা নেই প্রশাসনের তত্পরতায়৷ ধরা যাক , উপকূল বা নদীর ধার৷ চোখের সামনে ছোটো বড়ো প্রায় সব ক’টা নদীর প্লাবনভূমি দখল হয়ে যাচ্ছে দোকানপাট আর বসতবাড়িতে৷ ঠিক যেমন দিঘার উপকূলে৷ এ বলে আমায় দেখ , ও বলে আমায় দেখ৷ একটুও কম যায়নি বড়োলোকের শহর মুম্বইতে৷ সব থেকে বেশি তাচ্ছিল্য করা হয় পরিবেশের নিয়মকানুন আর ইকোলজির উপলব্ধিতে৷ ফল হাতে নাতে৷ কিন্ত্ত একচুল পাল্টাল না এই ইচ্ছামৃত্যুর প্রবণতা৷ এমনই মজা পুঁজিবাদী বুনিয়াদের৷
দ্বৈত প্রশাসনিক ব্যবস্থাইকোলজির ছাত্র হিসেবে আমাদের মূল কাজ হল ছড়ানো ছেটানো বিন্দুগুলি জোড়ার৷ আজ থেকে ৩৫ বছর আগে এই ভাবেই খুঁজে পেয়েছিলাম পূর্ব কলকাতার জলাভূমির অসামান্য অস্তিত্ব৷ আজ রাষ্ট্রপুঞ্জও সর্বশ্রেষ্ঠের স্বীকৃতি দিয়েছে এই জলাভূমিকে৷ এই জোড়া দেওয়াই আমাদের কাজ৷
খুঁজতে খুঁজতে মনে হল একটি নতুন ধরনের প্রশাসনিক বোঝাপড়া যেন কাজ করতে শুরু করেছে৷ এবং বেশ শক্তপোক্ত শিকড়ও গজিয়েছে৷ এই মুহূর্তে এই বোঝাপড়াকে আমি ‘দ্বৈত প্রশাসনিক ব্যবস্থা ’ বলতে পারি৷ যেমন ধরুন , গড়িয়াহাট মোড় , রাধাবাজার বা ধর্মতলা৷ এই সমস্ত জায়গায় হকারদের অধিকার স্বীকৃত৷ এদের পরিচালিত করেন এলাকার রাজনৈতিক শক্তি৷ শুধু তাই নয় , এখন নকশা -টালি দিয়ে ফুটপাথ বাঁধানোর ধুম পড়েছে৷ ভালো কথা৷ তবে ওই জায়গা দিয়ে বৃষ্টির যে জল মাটির নীচে ঢুকত, তা আর ঢোকে না৷ সে কথা জানান দিচ্ছে রাস্তা ভাসিয়ে , অল্প বৃষ্টিতেই৷ এগুলো কিন্ত্ত আমরা জানতাম না তা নয়৷ এখানেই শেষ নয়৷ ওই বাঁধানো ফুটপাথে দ্রুত দখল নিচ্ছেন নতুন দোকানি বা একটু এগিয়ে নেওয়া পুরনো দোকানটাই৷ ফুটপাথ বেচাকেনার জন্য৷ হাঁটার জন্য তো রাস্তা আছেই৷
ভালো দৃষ্টান্ত পূর্ব কলকাতার জলাভূমিতে৷ এখানে বেআইনি ভাবে কারা বাড়ি করবেন এই পুরো সিদ্ধান্তটাই রাজনৈতিক শক্তির দখলে৷ ঠিক যেমন ফুটপাথে কোন হকার কত দিয়ে বসবেন তা সমস্তটাই রাজনৈতিক শক্তির দখলে৷ পূর্ব কলকাতার জলা এলাকায় যে প্যাকেজটা চলে তার নাম ‘জলা ভরো , বাড়ি করো ’৷ দায়িত্বে এলাকার রাজনৈতিক পেশিশক্তি৷ ২০০২ সালে এখানকার একটা মৌজায় ৮৮ % জলা ছিল , ২০১৬ -তে কমে ১৯ % হয়েছে৷ কাজ চলছে৷ এই দখলদারির চত্বরটা নেহাত ছোটো নয়৷ অথচ দখলদারিটি মোটামুটি প্রতিষ্ঠিত৷ ভূমির উপযুক্ত ব্যবহারের ক্ষেত্রে সারা ভারতে একটি দ্বৈত প্রশাসনিক ব্যবস্থা নিঃশব্দে চালু আছে৷ অধিকাংশ ক্ষেত্রে প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের সম্পর্কের যে জোর , মানুষের টিকে থাকার যে শর্ত, এই দ্বৈত প্রশাসনিক ব্যবস্থা তার মূলে কুঠারাঘাত করে৷ এটা কতটা গুরুত্বপূর্ণ উপলব্ধি , ভবিষ্যত্ তার প্রমাণ রাখবে নিশ্চয়৷
লেখক আইএউসিএন -এর বিশেষ উপদেষ্টাপরিবেশকে উপেক্ষা করলে কী হতে পারে , তেমন বিপর্যয়ের দৃষ্টান্ত অজস্র৷ সরকারি নথিপত্রে এবং গবেষণায় তা স্বীকৃতও৷ তবুও কোথাও কারও হুঁশ ফিরল না৷ লিখছেন ধ্রুবজ্যোতি ঘোষঅজিত নাইনানস্মার্ট সিটি না বলে হট সিটি বললে কি খারাপ শোনাত ? বস্ত্তত আমরা ‘হট সিটি ’ প্রকল্পে নেমে পড়েছি৷ এর প্রথম কাজ হল গাছ কেটে ফেলা৷ তার পর সবুজ জমি না রাখা৷ যত বেশি বাড়ি করা যায় , করে ফেলা , তাতে লোক থাকুক না থাকুক পরোয়া নেই৷ সবার উপরে জলাভূমি বুজিয়ে ফেলা৷ সৌখিন কিছু জলাধার থাকবে , বাঁধানো সুইমিং পুল থাকবে , কিন্ত্ত জলাভূমি সমস্ত বুজিয়ে ফেলো৷