অ্যাপশহর

সরকারি ব্যাঙ্ক দোষী, বেসরকারি শিল্প নিষ্পাপ?

পাঞ্জাব ন্যাশনাল ব্যাঙ্ক যদি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের অদক্ষতার নিদর্শন হয়, নীরব মোদী বা মেহুল চোকসিও শিল্পজগত্ থেকে বিচ্ছিন্ন কোনও ব্যতিক্রম নন৷

EiSamay.Com 27 Feb 2018, 12:01 pm
পাঞ্জাব ন্যাশনাল ব্যাঙ্ক যদি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের অদক্ষতার নিদর্শন হয়, নীরব মোদী বা মেহুল চোকসিও শিল্পজগত্ থেকে বিচ্ছিন্ন কোনও ব্যতিক্রম নন৷ লিখছেন বৈজয়ন্ত চক্রবর্তী
EiSamay.Com post editorial on pnb fraud case
সরকারি ব্যাঙ্ক দোষী, বেসরকারি শিল্প নিষ্পাপ?


মোল্লা নাসিরুদ্দিনের এক চেনাজানা কিস্সা মনে পড়ছে ইদানীং৷ একদা মোল্লা সপরিবারে নেমন্তন্ন খেতে গিয়েছিল , ফিরে এসে দেখে এক নিশিকুটুম ঘরদোর পুরো সাফ করে দিয়ে গেছে৷ সকাল হতে না হতেই পাড়াপড়শির জটলা , এক -একজনের এক-এক মত৷ কেউ বলে , ‘বাপু হে , গেছিলে যখন , দোরে গন্ডাখানেক শক্তপোক্ত তালা লাগিয়ে যেতে পারোনি ?’

আবার কারও উপদেশ , ‘তোমার জানলাগুলো বড়োই হালকা -পলকা হে , কিপটেমি না করে ভালো সেগুন কাঠের জানলা লাগাতে পারতে৷’ মোল্লা কিছুই বলে না , তার দিকে গঞ্জনা ধেয়ে আসছে অবিরাম৷ কয়েক ঘণ্টা পর আর না থাকতে পেরে সে চেঁচিয়ে ওঠে , ‘আরে মশাই , সব দোষটাই কি আমার ? যে চোরটা চুরি করল তার কি কোনও দোষই নেই?’পাঞ্জাব ন্যাশনাল ব্যাঙ্ক -এ বিপুল আর্থিক নয়ছয় ধরা পড়ার পর নানা মুনির নানা মত৷ তবে সবার সব মত মূলত একটি ব্যাপারেই , সরকারি ব্যাঙ্কগুলোর দুর্দশা৷ এবং বেড়ালের পর রুমালের উদয় হওয়া যেহেতু প্রায় নিয়তির মতো , অতএব সব সরকারি ব্যাঙ্ক বেসরকারি করে দিলেই সমস্যার সমাধান এই দাবিতে সোচ্চার হয়ে উঠেছেন অনেকেই৷ সেটা হওয়ারই ছিল , কারণ দুর্দশার কাহিনিটি নিদারুণ সত্য৷

সাত বছর ধরে যদি বেআইনি লেনদেন ঘটে চলে , এবং প্রতি বছর হরেক কিসিমের অডিট সত্ত্বেও তা ধরা না পড়ে , সরকারি ব্যাঙ্কের উপর আস্থা হারানোটাই স্বাভাবিক৷ তার উপর যখন ঝোলার থেকে একের পর এক বেড়াল বেরোচ্ছে , দেখা যাচ্ছে যে, একা পাঞ্জাব ন্যাশনাল ব্যাঙ্ক নয় , কারচুপির ফলে ক্ষতিগ্রস্ত একাধিক ব্যাঙ্ক৷ অনাদায়ী ঋণের বোঝা যাদের কাঁধে , তাদের প্রথম দশটি সরকারি ব্যাঙ্ক৷ অতএব গোড়ায় যে গভীর গলদ সেটি অস্বীকার করার উপায় নেই৷

তবে বেসরকারি হাতে ব্যাঙ্ক গেলেই শান্তিকল্যাণ , এমন বিশল্যকরণীটির পক্ষে যাঁরা , তাঁরা হয়তো সাম্প্রতিক ইতিহাসটি ভুলে গিয়েছেন , স্বেচ্ছায় বা অনিচ্ছায়৷ একুশ শতকের আর্থিক মহাসংকট এসেছিল বিপুলাকার কিছু বেসরকারি ব্যাঙ্কের দৌলতে , এবং তা থেকে রক্ষা পেতে শেষ পর্যন্ত মার্কিন করদাতাদের পকেট থেকেই অর্থ জোগাতে হয়৷ ব্যাঙ্কিং ক্ষেত্র যেহেতু লতায় -পাতায় জড়িয়ে থাকে , এক ব্যাঙ্কের সর্দি হলেই ছোঁয়াচ লাগে অন্য সবখানে , কাজেই সঙ্কট দেখা দিলে সরকারকে হস্তক্ষেপ করতেই হয়, করদাতাদেরই অর্থে তাদের নিরাপত্তা জোগাতে হয় , সে সরকারি বা বেসরকারি , যে ব্যাঙ্কই হোক না কেন৷ এই প্রসঙ্গে আপাতত এটুকুই৷ কারণ ব্যাঙ্কিং ক্ষেত্র নিয়ে সোরগোলের মধ্যে চাপা পড়ে যাচ্ছে সঙ্কটের অন্য দিকটি৷

তালি কদাপি এক হাতে বাজে না৷ ব্যাঙ্কে ঋণখেলাপ কিংবা কারচুপি যারা করছে , করেই চলেছে , সেই সব সংস্থা কিন্ত্ত সম্পূর্ণ বেসরকারি৷ আশ্চর্যজনক ভাবে , চোরকে ঠেকাতে কী কী করা দরকার , তা নিয়ে সবাই সরব৷ এই প্রশ্নটা বিশেষ কেউ করছে না যে, ভারতের বেসরকারি শিল্পক্ষেত্রটিতে দুর্নীতির এত রমরমা কেন৷ সবাই নীরব মোদীকে নিয়ে রসিকতা উত্পাদনে ব্যস্ত৷ নীরব মোদী বা তার সমপদবীধারী ললিতবাবু যেন নেহাত ব্যতিক্রম , এমনটাই ভাবসাব৷ অর্থাত্, পাঞ্জাব ন্যাশনাল ব্যাঙ্কের অপদার্থতার দায় নিতে হবে প্রতিটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্ককে , অথচ নীরব মোদী , বিজয় মাল্য কিংবা মেহুল চোকসি , তাঁরা যেন কিছু বিচ্ছিন্ন ব্যক্তিত্বমাত্র , বাকি বেসরকারি শিল্পক্ষেত্রটি বিধৌত তুলসীপত্রসম৷

রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কগুলিকে ফোঁপরা করে দেওয়ার ঐতিহ্যটি নিয়ে স্পষ্ট কয়েকটি কথা বলেছিলেন রঘুরাম রাজন , ২০১৪ সালে ডক্টর ভার্গিস কুরিয়েন মেমোরিয়াল লেকচারে৷ তাঁর মতে , দেশে এমন একটি সিস্টেম তৈরি করা হয়েছে যেখানে বৃহত্ ঋণগ্রহীতাদের পোয়াবারো৷ ইচ্ছাকৃত ভাবে ঋণখেলাপ করলেও তাদের গায়ে আঁচটি লাগে না৷ এটিই হল মোদ্দা কথা৷ এটারই তিনি নাম দিয়েছিলেন ‘রিস্কলেস ক্যাপিটালিজম ’ ঝুঁকিহীন ধনতন্ত্র৷ প্রশ্ন তুলেছিলেন , যখন আর্থিক বৃদ্ধির হার শ্লথ , ক’জন বৃহত্ শিল্পপতিকে তাদের ঘরবাড়ি হারাতে হয়েছে , বা জীবনযাত্রায় কাটছাঁট করতে হয়েছে৷

বৃহত্ ঋণগ্রহীতারা যে এই ভাবে রেহাই পাচ্ছে , ব্যাঙ্কের গাফিলতি ছাড়া তো তা সম্ভব ছিল না ? এখানে রঘুরাম রাজনের একটি বিশদ উদ্ধৃতি জরুরি ‘জনগণ ভাবে যে, বৃহত্ শিল্পপতি হেসেখেলে দিন কাটায় কারণ তার সঙ্গে ব্যাঙ্কারের ‘সুইট ডিল ’৷

ব্যাঙ্কে সম্ভাব্য দুর্নীতির সাম্প্রতিক কিছু খবরে এই মতটি মান্যতা পেয়েছে , কিন্ত্ত আমার ধারণা ওকাম ’স রেজর -এর সাহায্যে এর আরও প্রাসঙ্গিক একটি ব্যাখ্যা পাওয়া সম্ভব --- চলতি সিস্টেমে বৃহত্ এবং প্রভাবশালী শিল্পপতির নিরিখে ব্যাঙ্কার অসহায় ’৷

‘প্রভাব ’! শব্দটি এ ক্ষেত্রে যে কী ব্যঞ্জনাময় ! ইংরেজিতে ‘ক্রোনি ক্যাপিটালিজম ’ বলে একটি শব্দ আছে৷ তার অর্থ হল , এমন একটি ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থা যেটিতে মুনাফা অর্জনের জন্য ঝুঁকি নিতে হয় না , তা আসে ব্যবসায়ী শ্রেণি ও রাজনৈতিক শ্রেণির মধ্যে যোগসাজস মারফত্৷ এ ক্ষেত্রে প্রভাব ত্রিবিধ --- আর্থিক, সামাজিক , এবং সবার উপরে যাহা চরম সত্য --- রাজনৈতিক৷ পিএনবি কেলেঙ্কারির পর বিজেপি ও কংগ্রেসের মধ্যে তুইথুলি মুইথুলি চলছে বটে , কিন্ত্ত দুর্নীতির অসুখটি যে ইউপিএ আমলে বেশ বড়ো মাপেই ছিল , সেটি প্রমাণিত এবং সর্বজনবিদিত৷ এবং এখন বিজেপি কংগ্রেসের দিকে যতই আঙুল তুলুক, নিখাদ সত্যটি হল , দুর্নীতি ও কালো টাকা নিয়ে তাদের প্রতিনিয়ত বাগাড়ম্বর সত্ত্বেও ট্র্যান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল প্রকাশিত ২০১৭ -র ‘কোরাপশন পারসেপশন ইনডেক্স ’-এ ভারত ১৮০টি দেশের মধ্যে ৮১তম স্থানে৷ এবং , ২০১৬ -র তুলনায় অবস্থা আরও খারাপ হয়েছে৷ ২০১৬ সালে ভারত ছিল ৭৯তম স্থানে৷ অতএব কার দায় কতটা , এই হিসেব কষতে বসলে কূল পাওয়া ভার৷ বরং সত্যের এবং জনগণেশের খাতিরে মেনে নেওয়া ভালো , রোগটি সর্বব্যাপী৷

একটি দেশে রাজনীতিবিদ -শিল্পপতি -আমলাতন্ত্রের আঁতাত কতটা ছড়িয়েছে , তার প্রধান লক্ষণ তিনটি৷ প্রথম , বড়ো মাপের দুর্নীতিকাণ্ডের প্রকোপ৷ দ্বিতীয় , বাড়তে থাকা আর্থিক অসাম্য৷ তৃতীয় , রাজনৈতিক দলগুলির তহবিল জোগাড়ের ক্ষেত্রে অস্বচ্ছতা৷ প্রথমটির উদাহরণ অসংখ্য৷ এনডিএ সরকারের তুলনামূলক ভাবে কেলেঙ্কারিহীন প্রথম কয়েক বছরের পর যাঁরা ঊর্ধ্ববাহু ছিলেন , তাঁদের জোশও সম্প্রতি কমতির দিকে৷ অতএব , তা নিয়ে বিশেষ বাক্যব্যয় নিরর্থক৷

অন্য দিকে আর্থিক অসাম্য বিপজ্জনক স্তরে৷ যদি কোনও অর্থনীতিতে দেখা যায় , দেশের বৃহদংশ মানুষের অবস্থার যেটুকু উন্নতি হয়েছে , তার থেকে বহু গুণ শ্রীবৃদ্ধি অর্থনৈতিক পিরামিডের একেবারে উপরের তলায় থাকা কিছু মানুষের , বুঝে নিতে হবে , এটা খুব স্বাভাবিক নয়৷ সমাজতন্ত্র বা মিশ্র অর্থনীতি ছেড়েই দেওয়া গেল , এমনকি মুক্ত বাজার -ভিত্তিক উদারপন্থী ধনতন্ত্রেও সাধারণত এমনটি ঘটে না৷ ক্রেডিট সুইস-এর তথ্য অনুযায়ী , ভারতের সব থেকে ধনী ১ শতাংশ মানুষের হাতে দেশের মোট সম্পদের ৫৮ .৪ শতাংশ৷ এবং খুব দ্রুত হারে মুষ্টিমেয় কিছু মানুষের কাছে চলে যাচ্ছে অধিকাংশ সম্পদ৷ ২০১৪ -য় এই ভাগ ছিল ৪৯ শতাংশ , ২০১৫ -য় তা বেড়ে দাঁড়ায় ৫৩ শতাংশে৷ ভারতের একুশ শতক কি তা হলে ক্রমবর্ধমান অসাম্যের পর্ব? বলাটা খুব একটা ভুল হবে না , কারণ ২০০০ সালে মোট সম্পদের ৩৬ .৮ শতাংশ ছিল সব থেকে ধনী ১ শতাংশের হাতে৷ আন্তর্জাতিক মাপকাঠিতে অসাম্যের নিরিখে ভারত দ্বিতীয় স্থানে৷ প্রথম কে? অবশ্যই রাশিয়া , যাকে ‘ক্রোনি ক্যাপিটালিজম ’-এর আঁতুড়ঘর বলা হয়৷ সে দেশে ধনীতম ১ শতাংশের হাতে জাতীয় সম্পদের ৭৪ .৫ শতাংশ৷ তা হলে ভারত ক্রমে রাশিয়ার পথে ?সম্ভাবনাটি উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না , কারণ তহবিল সংগ্রহের বিশদ তথ্য প্রকাশে রাজনৈতিক দলগুলির তীব্র অনীহা৷ মনে করুন , কেন্দ্রীয় তথ্য কমিশন যখন রাজনৈতিক দলগুলিকে তথ্যের অধিকার আইনের আওতায় নিয়ে আসার প্রস্তাব পেশ করে , সব ভেদাভেদ ভুলে সমস্ত দল সমস্বরে প্রতিবাদ করেছিল৷ অ্যাসোসিয়েশন অফ ডেমোক্রেটিক রিফর্মস -এর বিশ্লেষণ অনুযায়ী , ২০১২ থেকে ২০১৬ সালের মধ্যে রাজনৈতিক দলগুলি যে আর্থিক অনুদান পেয়েছে , এবং যার উত্সটি জ্ঞাত, তার ৮৯ শতাংশই এসেছে কর্পোরেট ক্ষেত্র থেকে৷ নির্বাচনে কর্পোরেট -এর মাত্রাতিরিক্ত প্রভাব নিয়ে সমস্যায় বহু দেশই৷ জাপান ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও যার মধ্যে৷ কিন্ত্ত সে সব দেশেও কে কার বা কাদের কাছ থেকে কত অর্থ পেল , সেই হিসেবনিকেশটি জনসাধারণের কাছে মোটের উপর স্পষ্ট৷ ভারতে রাজনৈতিক দলগুলির অর্থভাণ্ডারের ৬৯ শতাংশই কোথা থেকে এসেছে , তা জানার কোনও উপায় নেই৷ অথচ উপার্জন বেড়েছে বেশ তড়িত্ গতিতেই৷ ধনীতম ১ শতাংশ মানুষজনের মতোই৷ গত এক দশকে জাতীয় দলগুলির আয়বৃদ্ধির হার ৩১৩ শতাংশ , আঞ্চলিক দলগুলির তারও দ্বিগুণ , ৬৫২ শতাংশ৷

অর্থাত্, এমন একটি দেশে আমাদের বাস , যেখানে ক্ষমতার প্রধান দুই উত্স , রাজনৈতিক প্রভাবশালী এবং অর্থনৈতিক প্রভাবশালী , এই দুই শ্রেণির মধ্যে দেওয়া -নেওয়ার খতিয়ানটিই অমিল৷ এবং সেটি প্রকাশ করার ক্ষেত্রে কারও বিশেষ কোনও চাড় নেই৷ রাজনৈতিক দলগুলি তো পণ করে আছে যে তারা কিছুতেই তথ্যের অধিকার আইনের আওতায় আসবে না৷ এবং যেহেতু আইনকানুন তৈরির যাবতীয় ক্ষমতা তাদেরই হাতে , নিজের পায়ে কুড়ুল মারে কে? ফলে , রাজনৈতিক প্রভাব কাজে লাগিয়ে কেলেঙ্কারির ট্র্যাডিশনটি চলছে এবং আপাতত চলবে বলেই মনে হচ্ছে৷

হ্যাঁ, গণতন্ত্রের একটি অংশের দায়িত্ব ছিল , রাজনৈতিক দলগুলি যে তথ্য জনসমক্ষে প্রকাশ করতে চায় না , তাকে খুঁজেপেতে আম দরবারে হাজির করার৷ নতুবা গণতন্ত্র নামে কিছু একটা থাকে বটে , কিন্ত্ত আদতে তা সারবস্ত্তহীন৷ তেমন কিছুও আদৌ হচ্ছে কি ? সেই প্রশ্নের উত্তর খোঁজাটাও জরুরি৷

পরের খবর

Editorialসম্পর্কে আরও বিস্তারিত ও নতুন খবর জানতে ক্লিক করুন। সব ধরনের ব্রেকিং, আপডেট এবং বিশ্লেষণ সবার প্রথম বাংলায় পড়তে ক্লিক করুন Bengali Newsএই সময় ডিজিটাল