অ্যাপশহর

বিচ্ছেদ অনিবার্যই ছিল, ভাগ্যিস দ্রুত হয়েছে

এ ভাবে কুম্বলের বিদায় দুঃখজনক বটে , তবে কোহলির সঙ্গে তাঁর সাময়িক মিটমাটে দীর্ঘমেয়াদে ভারতীয় ক্রিকেটের কোনও লাভ হত না৷

EiSamay.Com 27 Jun 2017, 12:12 pm
এ ভাবে কুম্বলের বিদায় দুঃখজনক বটে , তবে কোহলির সঙ্গে তাঁর সাময়িক মিটমাটে দীর্ঘমেয়াদে ভারতীয় ক্রিকেটের কোনও লাভ হত না৷ এ বার নতুন পথসন্ধান শুরু হোক৷ লিখছেন বোরিয়া মজুমদার
EiSamay.Com post editorial on anil kumble quit as india coach
বিচ্ছেদ অনিবার্যই ছিল, ভাগ্যিস দ্রুত হয়েছে


এমনই একজন কোচ দরকার যিনি কার্স্টেনের মতো কার্যকর কিন্ত্ত চ্যাপেল বা কুম্বলের মতো ডাকাবুকো নন

ভারতীয় ক্রিকেট দলের কোচ হিসেবে অনিল কুম্বলে-জমানা শেষ হল৷ এ বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই যে তাঁর প্রস্থান যে ভাবে হল , তাঁর মতো একজন কিংবদন্তি খেলোয়াড়ের ক্ষেত্রে তাকে ঠিক মানানসই বলা যায় না৷ এও ঠিক যে ক্যাপ্টেন এবং কোচের মধ্যে মতান্তর তৈরি হয়েছিল , এবং বিসিসিআই গোটা বিষয়টিকে আরও ভালো ভাবে সামলাতেই পারত৷ বিসিসিআইয়ের শীর্ষ মহল এই মতান্তরের কথা অস্বীকার না করলেই ভালো হত৷ বিসিসিআইয়ের অস্থায়ী সচিব অমিতাভ চৌধুরী তো ইংল্যান্ডে পৌঁছে কোহলি ও কুম্বলের মধ্যে এই মতান্তরকে সাংবাদিকদের কষ্টকল্পনা বলে ব্যঙ্গ করেছিলেন৷ সকলেই পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছিলেন কী হচ্ছে , অথচ পাক্কা তিন সন্তাহ ধরে বিসিসিআইয়ের প্রত্যেকে ব্যপারটা অস্বীকার করে গেলেন৷

কিন্ত্ত মোদ্দা কথা হল , যা হওয়ার তা হয়ে গিয়েছে এবং কোনও প্রধান কোচ ছাড়াই ভারতীয় দল ক্যারিবিয়ানে পৌঁছেছে৷ এমনটা যে প্রথম ঘটল , তাও অবশ্য নয়৷ কিন্ত্ত এখন একজন প্রধান কোচ নিযুক্ত করা আগের থেকে আরও বেশি জরুরি , তাই সে কাজটা সেরে এগিয়ে যাওয়াই ভালো৷ ক্যাপ্টেন আর কোচের এই মতান্তর মুখটা খাট্টা করে গেল ঠিকই , কিন্ত্ত তা থেকে কী কী শিক্ষা নেওয়া যেতে পারে , পরের কোচ ঠিক করার সময় বিসিসিআইয়ের কী মাথায় রাখা উচিত সেটা বুঝে নিয়ে এবার এগিয়ে যাওয়াই কর্তব্য৷ বিসিসিআই জানিয়ে দিয়েছে , পরের মাসেই পরবর্তী কোচ ঠিক করে ফেলা হবে৷ কাজেই বিভিন্ন জনের সাক্ষাত্কার নিয়ে , তারপর একটি সিদ্ধান্তে পৌঁছনোর জন্য খুব বেশি সময় যে আর হাতে নেই , এ কথা বলতেই হবে৷

ক্রিকেট ফুটবলের মতো নয় , এ খেলা রীতিমতো ক্যাপ্টেন -চালিত৷ মোটামুটি ভাবে বলা যেতে পারে , দলটি ক্যাপ্টেনেরই গড়া এবং সে দল ব্যর্থ হলে নিশানা হতে হয় ক্যাপ্টেনকেই৷ গুরুত্বপূর্ণ কোনও টুর্নামেন্ট জিতলে যেমন তাঁকে মাথায় তুলে নাচা হয় , ঠিক তেমনই চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে পাকিস্তানের কাছে ভারত যে ভাবে হারল সে ভাবে হারলে তাঁর গর্দানের উপরেই কোপ পড়ে৷ যেমন ধরুন , এমনটা তো বলা হয়েই থাকে যে , বিশ্বজয় করেছিল স্টিভ ওয়ার অস্ট্রেলিয়া , বা বলা হয় রিকি পন্টিংয়ের দল ২০০৩ এবং ২০০৭ -এ পরপর দুবার বিশ্বকাপ জিতে ছিল৷ আবার ২০১১-র বিশ্বকাপ জিতেছিল মহেন্দ্র সিং ধোনির দল৷ চট করে যদি প্রশ্ন করা হয় , ১৯৯৯ -এ অস্ট্রেলিয়া দলের কোচ কে ছিলেন অনেককেই উইকিপিডিয়ার স্মরণ নিতে হবে৷ যেবার অস্ট্রেলিয়া ভারতকে ৪ -০ হারিয়েছিল সে বার যে মিকি আর্থার কোচ ছিলেন , এ কথা আর কেই বা মনে রাখেন ? সে জয়ে পালক চড়েছিল মাইকেল ক্লার্কের মুকুটে , এবং সে পালক সেখানেই থেকে যাবে৷ আসলে এ খেলার ধরনটাই এ রকম , কিছু করার নেই৷

তার মানে কি এই যে , বিরাট কোহলিই ঠিক করবেন ভারতীয় দলের পরবর্তী কোচ কে হবেন এবং সেই কোচ কোহলির অঙ্গুলিহেলনে উঠবেন বসবেন ? এ প্রশ্নের দ্ব্যর্থহীন উত্তর একটাই --- না৷ কিন্ত্ত এর পাশাপাশি এটাও ঠিক যে যিনিই পরবর্তী কোচ হোন না কেন , তাঁকে ক্যাপ্টেনের সঙ্গে সুসম্পর্ক তৈরি করতে হবে , এগিয়ে যেতে গেলে দলপতির সঙ্গে একটা যোগাযোগ গড়ে তুলতে হবে৷ আগামী ১৮ মাসে দক্ষিণ আফ্রিকা , ইংল্যান্ড এবং অস্ট্রেলিয়ায় ভারত যদি ভালো ফল করতে চায় , তা হলে কোহলি ও দলের অন্যান্য খেলোয়াড়দের এমন একজন কোচ দরকার যিনি তাঁদের কথা বুঝবেন , তাঁদের সঙ্গে একটা তালমিল তৈরি করতে পারবেন৷ আমরা মানি বা না মানি , কোচ বাছাইয়ের ক্ষেত্রে এই সুসম্পর্কের বিষয়টার গুরুত্ব অপরিসীম৷ বিগত দেড় দশকের কথা ধরলে দেখা যাবে যে ভারতের প্রধান কোচ হিসেবে তিন জন দারুন কাজ করেছেন৷ এই সময়ের মধ্যে অবশ্য অনিল কুম্বলের এক বছর ধরছি না৷ প্রথম জন ছিলেন জন রাইট৷ দ্বিতীয় জন , এবং সম্ভবত সেরা ছিলেন গ্যারি কার্স্টেন৷ তাঁর সময়েই ভারত টেস্ট দল হিসেবে তালিকার একেবারে উপরে নিজের স্থান করে নেয় এবং দেশে বিশ্বকাপ জেতে৷ তৃতীয় জন হলেন রবি শাস্ত্রী যিনি একাধারে দলের ডিরেক্টর ও কোচের ভূমিকা পালন করেন , এবং তাঁর দেড় বছরের সময় কালে বেশ ভালোই সফল হয়েছিলেন৷ আর যদি চরম ব্যর্থতার উদাহরণ হিসেবে কারও নাম করতে হয় , তো বলতে হবে গ্রেগ চ্যাপেলের নাম৷ সে সময়ের ভারতীয় দলের যে কোনও সদস্যকে জিজ্ঞেস করুন , তিনিই বলবেন যে ড্রেসিং রুমের উপর গ্রেগের প্রভাবকে ঠিক ভালো বলা অসম্ভব৷ অনিল কুম্বলের সঙ্গে গ্রেগ চ্যাপেলের মোটেই তুলনা চলে না৷ সত্যি বলতে কী , কোচ হিসেবে কুম্বলের রেকর্ড প্রায় নিষ্কলুষ --- তাঁর সময়ে দেশে খেলা সব ক’টি সিরিজ জেতে ভারত , চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির ফাইনালেও উঠেছিলাম আমরা৷ তা সত্ত্বেও এ কথা বলতেই হবে যে , ভারতীয় ক্রিকেটে দেখা গিয়েছে নিজস্ব মতামতে অটল থাকার প্রবণতাসম্পন্ন দু’ জন এক সঙ্গে কিছুতেই চলতে পারেন না৷ কুম্বলে ভারতীয় ক্রিকেটের এক জন কিংবদন্তি খেলোয়াড়৷ কিন্ত্ত তিনি হয়তো কোচ হিসেবে একটা ভুল করছিলেন তিনি চাইছিলেন দলটা যতটা কোহলির হবে ততটাই যেন তাঁর হয়৷ কার্স্টেন পাদপ্রদীপের আলো সম্পূর্ণ ছেড়ে দিয়েছিলেন ধোনির জন্য৷ কুম্বলে কিন্ত্ত ঠিক তেমনটা ছিলেন না৷ আসলে কুম্বলের পরিচয়টাই এমন যে ড্রেসিং রুমের উপর তাঁর ছায়া যে দীর্ঘ হবে , তাতে অবাক হওয়ার কিছু নেই তাঁর ঝুলিতে ৬১৯টি উইকেট , ম্যাচ -জেতানো খেলোয়াড় বলতে সবার আগে ওঠে তাঁর নাম৷ কিন্ত্ত দলের এগিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে সেটা বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল বলেই মনে হয়৷

তিনি সংবাদমাধ্যম থেকে নিজেকে সরিয়ে রাখলেও , ড্রেসিং রুমের মধ্যে তিনি যতটা মেন্টরের ভূমিকা নিতে পেরেছিলেন তার থেকে বেশি প্রকট হয়ে উঠেছিল তাঁর নির্দেশ দেওয়ার ভূমিকা৷ অধিকাংশ ভারতীয় খেলোয়াড়ের কাছ থেকে যা শোনা যাচ্ছে, তাতে দেখা যাচ্ছে তাঁরা কুম্বলের সামনে খোলাখুলি নিজের মনের কথা বলতে কিছুটা অস্বস্তি বোধ করতেন৷ আগামী দিনে আমাদের এমন এক জন কোচ দরকার যিনি গ্যারি কার্স্টেনের মতো কার্যকর কিন্ত্ত গ্রেগ চ্যাপেল বা অনিল কুম্বলের মতো ডাকাবুকো নন৷ এমন একজনকে চাই যিনি দলের খেলোয়াড়দের মেন্টর হয়ে উঠবেন, নির্ভরশীল ব্যক্তিত্বের একজন , কিন্ত্ত যাঁকে সংবাদমাধ্যম সারাক্ষণ খুঁজে বেড়াবে না৷ কোনও ঝলমলে কিংবদন্তির থেকে কোচ হিসেবে অনেক বেশি দরকার এমন এক জনকে যিনি একঘেয়ে নিত্যনৈমিত্তিকতায় দলের খেলোয়াড়দের কাছ থেকে সাফল্য আদায় করে নিতে পারবেন৷ চাই এমন কাউকে যাঁর ক্রিকেটিয় জ্ঞান প্রশ্নাতীত, কিন্ত্ত যিনি সাফল্যের আলো খুশি মনে ক্যাপ্টেনের উপরেই পড়তে দেবেন৷ আর একটা কথা বলতেই হবে এই কোচকে নিয়োগ করতে হবে দীর্ঘমেয়াদি ভিত্তিতে , যাতে তিনি দলের সঙ্গে একটা পাকাপাকি যোগাযোগ তৈরির সময় পান এবং ২০১৯ -এর বিশ্বকাপের জন্য একটা পরিকল্পনা খাড়া করে ফেলতে পারেন৷ দু’বছর পরেই অনুষ্ঠিত হতে চলেছে ক্রিকেটের সব থেকে বড়ো প্রতিযোগিতা৷ কোহলি এবং তাঁর দল যাতে নতুন কোচের সঙ্গে একত্রে সেই প্রতিযোগিতার জন্য একটা পথরেখা তৈরি করতে পারেন , সে সময়টা তাঁদের দিতেই হবে৷

যে ভাবে কুম্বলে -পর্ব শেষ হল , তা দুঃখজনক৷ কিন্ত্ত ভারতীয় ক্রিকেটের দীর্ঘমেয়াদি স্বার্থ মাথায় রেখে বলা যায় , এই ছাড়াছাড়িটা যে খুব দেরি হওয়ার আগেই হয়ে গিয়েছে সেটা এক দিক থেকে ভালো৷ একটা মিটমাটের কথা বলা হচ্ছিল বটে , কিন্ত্ত সেটা হলে দীর্ঘমেয়াদে দলের ক্ষতিই হত৷ যেমনটা কুম্বলে বলেছেন , সম্পর্কটা আর বজায় রাখা যাচ্ছিল না৷ সে পরিস্থিতিতে দু’জনের এক জনকে সরে দাঁড়াতেই হত৷ আর সত্যি কথা হল , ক্রিকেট যে ধরনের খেলা তাতে কুম্বলের পক্ষেই সেটা স্বাভাবিক ছিল৷ আগামী কয়েক দিনের মধ্যেই পরবর্তী কোচ খোঁজা শুরু করতে চলেছে বিসিসিআই৷ আশা করা যায় কুম্বলে -পর্ব থেকে যে শিক্ষা পাওয়া গেল , তা তাঁরা মাথায় রাখবেন৷ সংবাদমাধ্যমকে খুশি রাখতে বিরাট মাপের কাউকে বাছার কোনওই প্রয়োজন নেই৷ এমন এক জন দরকার , যিনি কাজের কাজ করতে পারবেন --- ব্যাস্, সেটাই দরকার , আর কিচ্ছু না৷ এ ক্ষেত্রে আইপিএল একটি অনুসরণযোগ্য উদাহরণ হতে পারে৷ যে দু’টি দল এ বছর ফাইনাল খেলল , তাদের কোচ ছিলেন মাহেলা জয়বর্ধনে এবং স্টিফেন ফ্লেমিং৷ এখানে আমরা কি একটা বিশেষ আদল দেখতে পাচ্ছি ? হয়তো পাচ্ছি৷ দু’ জনেই কোচ হিসেবে খুবই কার্যকর হওয়া সত্ত্বেও জনসমক্ষে তাঁদের কাউকেই মুখ খুলতে প্রায় দেখাই যায়নি৷ মাহেলাকে তো প্রায় কখনও চোখেই পড়েনি৷ কিন্ত্ত বিজয়ী মুম্বই দলের কোচ ছিলেন তিনিই এবং দলের খেলোয়াড়রা তাঁর খুবই প্রশংসা করে থাকেন৷ এটাই এ মুহূর্তে ভারতীয় ক্রিকেটের দরকার-বিতর্কহীন একটা শান্ত সময়৷

লেখক ক্রীড়া ঐতিহাসিক

পরের খবর

Editorialসম্পর্কে আরও বিস্তারিত ও নতুন খবর জানতে ক্লিক করুন। সব ধরনের ব্রেকিং, আপডেট এবং বিশ্লেষণ সবার প্রথম বাংলায় পড়তে ক্লিক করুন Bengali Newsএই সময় ডিজিটাল