অ্যাপশহর

শিক্ষার সুযোগ স্বল্প, তবুও তোষণের অভিযোগ?

ধর্মীয় পরিচয় দিয়ে নয়, অনগ্রসর জাতিগোষ্ঠী হিসেবে মুসলমানদের বিবেচনা করে , তাদের উন্নয়নের জন্য অবিলম্বে নীতি -নির্ধারণ জরুরি৷

Ei Samay 31 Jul 2017, 12:38 pm
ধর্মীয় পরিচয় দিয়ে নয়, অনগ্রসর জাতিগোষ্ঠী হিসেবে মুসলমানদের বিবেচনা করে , তাদের উন্নয়নের জন্য অবিলম্বে নীতি -নির্ধারণ জরুরি৷ লিখছেন সাবির আহমেদ
EiSamay.Com post editorial on all india survey on higher education
শিক্ষার সুযোগ স্বল্প, তবুও তোষণের অভিযোগ?


রাজ্যে মুসলমান তোষণ হচ্ছে বলে যে রাজনৈতিক বিষ প্রতি দিন ঢেলে দেওয়া হচ্ছে , তা কতখানি অসার উচ্চশিক্ষায় মুসলমানদের অংশগ্রহণ দেখেই বোঝা যায়৷ সম্প্রতি মানব উন্নয়ন মন্ত্রক উচ্চশিক্ষার সর্বভারতীয় সমীক্ষার (অল ইন্ডিয়া সার্ভে অন হায়ার এডুকেশন ) ইউনিট স্তরে তথ্য প্রকাশ করছে৷ এই তথ্য অনুসারে উচ্চশিক্ষায় রাজ্যের গর্ব প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ে ২০১৫ -১৬ -তে কোনও মুসলমান ছাত্র -ছাত্রীর নথিভুক্তি হয়নি৷

রাজ্যে আর এক খ্যাতনামা উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে দেখা যাচ্ছে ২০১৫ -২০১৬ সালে সাকুল্যে ৫০ জন মুসলমান ছাত্র -ছাত্রীর নথিভুক্তি হয়েছে৷ আর একটু ভেঙে দেখা যাক , মুসলমান ছাত্র -ছাত্রী যেহেতু এত কম , তা শতাংশের হিসাবে দেখানো সম্ভব নয় , ২০১৪ -১৫ সালে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে মোট ছাত্র -ছাত্রীর সংখ্যা ছিল ১০ ,৫২৬ , এর মধ্যে মুসলমান মাত্র ৮৯ জন৷ গত দশ বছরে এ বিষয়ে তথ্য অনুসন্ধান করতে গিয়ে দেখা গেছে , রাজ্যে উচ্চশিক্ষায় যে প্রতিষ্ঠানগুলি যত উত্কৃষ্ট , সেখানেই মুসলমান ছাত্রছাত্রীদের আণুবীক্ষণিক উপস্থিতি৷ উচ্চশিক্ষায় মুসলমানদের আণুবীক্ষণিক অংশটাই সমাজে তাঁদের ক্ষমতার অবস্থানগত মান সম্পর্কে স্পষ্ট ইঙ্গিত দেয়৷ শিক্ষার সঙ্গে সক্ষমতার যোগ শিক্ষার স্তরভেদে লক্ষ করা যায় , লিখতে ও পড়তে জানলে জীবনের গুণগত মানের প্রভূত উন্নতি ঘটে৷ শিক্ষার ও বিশেষ কাজে দক্ষতার সঙ্গে কর্মসংস্থানের সুযোগ জড়িত৷ ইউনেস্কো মনে করে শিক্ষা লাভের সঙ্গে সঙ্গে দারিদ্র বিমোচনের পথও সহজ হয়ে যায়৷ উচ্চশিক্ষা সুযোগের ব্যান্তি অনেকখানি বাড়িয়ে দেয় , শিক্ষার বিস্তারের সঙ্গে সঙ্গে নাগরিক নিজের মানবাধিকার সম্পর্কে জানতে পারে , আইনি অধিকারের বাস্তব রূপায়ণ করতে শেখে এবং নাগরিক রাজনৈতিক বক্তব্য পেশ করতে পারে৷

শ্রেণি ও জাতিবৈষম্য কমানোর ক্ষেত্রে উচ্চশিক্ষা গুরত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে , এবং করেও থাকে৷ দার্শনিক মার্থা নুসবম সামাজিক প্রগতির জন্য উচ্চশিক্ষার উপর জোর দিতে গিয়ে বলছেন , ‘আমরা খুব সহজেই দেখতে পাই যে আমরা যখন প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা থেকে উচ্চশিক্ষার দিকে যাই , তখন এই লক্ষ্যগুলো হারিয়ে যায় না৷ প্রকৃতপক্ষে সেগুলো আরও জরুরি হয়ে ওঠে , যেহেতু এ যাবত্ প্রান্তিক হয়ে থাকা গোষ্ঠীগুলোর সামাজিক ক্ষমতার উপরে বিশ্ববিদ্যালয় স্তরে যে শিক্ষা দেওয়া হয় তার শক্তিশালী প্রভাব পড়ে৷ ’ উচ্চশিক্ষার সর্বভারতীয় সমীক্ষায় উচ্চশিক্ষায় সামাজিক জনগোষ্ঠীর অংশগ্রহণের ছবি দেখতে পাওয়া যায়৷ এই সমীক্ষা অনুসারে বিগত তিন বছরে রাজ্যের কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় মিলিয়ে মোট নথিভুক্ত ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে মুসলামানদের অংশগ্রহণ ৮ শতাংশ , সারা দেশের ক্ষেত্রে এটা তিন শতাংশেরও নীচে৷ উচ্চশিক্ষায় রাজ্যে উত্কর্ষ কেন্দ্রগুলিতে মুসলমানদের অংশগ্রহণ কম হলেও মুসলমান অধ্যুষিত মালদায় গৌড়বঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের সঙ্গে সঙ্গে উল্লেখজনক ভাবে মুসলমানদের অংশগ্রহণ দেখা যায় ; বিশ্ববিদ্যালয়ের ২৭ শতাংশ ছাত্র মুসলমান৷ এ ছাড়া রাজ্যের সংখ্যলঘু দন্তর পরিচালিত আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে মুসলমান ছাত্রের আধিক্য দেখা দেয়৷ উচ্চশিক্ষায় মুসলমানদের লক্ষণীয় অনুপস্থিতির কারণ কী হতে পারে ? এই সংক্ষিন্ত পরিসরে কয়েকটি কারণ তুলে ধরার চেষ্টা করলাম৷ প্রথমত , সমাজ কাঠামোতে শহরের আধিপত্যের ফলে উচ্চশিক্ষা কেন্দ্রগুলি বেশির ভাগ শহরকেন্দ্রিক৷

রাজ্যের মুসলমানদের বেশির ভাগই গ্রামে থাকে৷ মুসলমান -অধ্যুষিত এলাকাতে জনসংখ্যার অনুপাতে কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম৷ গবেষণায় দেখা যাচ্ছে , এটা আশা করা হয় কলকাতার ১৯ থেকে ২৯ বছর বয়সী ১১ হাজার ছেলেমেয়ের জন্য একটি কলেজ থাকবে৷ রাজ্যের ক্ষেত্রে উক্ত বয়সের প্রতি ৩৪ হাজারে একটি কলেজ৷ অন্য দিকে যেখানে মুসলমান অধ্যুষিত জেলাগুলিতে ওই বয়সী ৫৬ হাজার প্রতি একটা কলেজ৷ উত্তর দিনাজপুরের ক্ষেত্রে একটা কলেজ প্রতি এই সংখ্যা ৭৬ হাজার৷ পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়ার প্রবল ইচ্ছা থাকলেও আর্থিক কারণে মেধাবী মুসলমান ছাত্র -ছাত্রী মাঝ পথে পড়া ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়৷ প্রতীচী -অ্যাসোসিয়েশন স্ন্যাপ -এর রিপোর্ট থেকে জানা যায় রাজ্যের মুসলমানদের ৮০ শতাংশ পরিবারের আয় ৫০০০ হাজার টাকার নীচে৷ অন্য দিকে উচ্চ -শিক্ষার ক্রমশ ফি বৃদ্ধি ও বেসরকারিকরণের ফলে আর্থিক ভাবে অসচ্ছল পরিবারের কাছে উচ্চ শিক্ষা অধরা৷

আর্থিক ভাবে খানিক সচ্ছল হলেও শহরের সঙ্গে সামাজিক যোগাযোগের অভাবে গ্রাম থেকে আসা ছেলেমেয়ের বাসস্থানের জোগাড় করতে হিমশিম খেতে হয় , মুসলমান ছাত্র -ছাত্রীদের ঘর ভাড়া পেতে সমস্যা , কারণ কেবল কলকাতায় নয় , জেলা শহরেও একই ভাবে তাদের সন্দেহের চোখে দেখা হয়৷ উচ্চ -শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলির ছাত্রাবাসগুলিতে সুযোগ পাওয়া খুবই দুর্লভ৷ প্রাক -স্বাধীনতা যুগে প্রতিষ্ঠিত কলকাতায় মুসলমান ছাত্র -ছাত্রীদের হোস্টেলে সাকুল্যে দেড় হাজার ছাত্র -ছাত্রী থাকতে পারেন৷ শিক্ষার অধিকার আইনের ফলে বিনামূল্যে ৬-১৪ বছর বয়সী শিশুদের বিনামূল্যে পড়াশুনোর সুযোগ তৈরিতে প্রাথমিক , মাধ্যমিক ও উচ্চ -মাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত মুসলমান ছাত্র -ছাত্রীদের অংশগ্রহণ বাড়ছে৷ তবে সরকারি পরিসংখ্যান অনুসারে , মাধ্যমিক শিক্ষার পর থেকেই মুসলমান ছাত্র -ছাত্রীদের মধ্যে স্কুল -ছুট হওয়ার একটা তীব্র ঝোঁক দেখা যাচ্ছে৷ সমাজ ব্যবস্থায় এখনও পুরুষকে অর্থ-উপার্জনকারী হিসাবে ভাবা হয় , রাজ্যে মুসলমান ছেলেদের মধ্যে স্কুল স্কুল -ছুট হওয়ার প্রবণতা বেশি করে দেখা হচ্ছে৷ এই কারণেই অন্যান্য সামাজিক গোষ্ঠীর তুলনায় মুসলমান ছাত্রদের বিদ্যালয়ে থাকার গড় বছর খানিক কম৷ আর্থিক কারণের সঙ্গে সঙ্গে উচ্চশিক্ষা যে ভবিষ্যতে রুটিরুজি জোগানোর ব্যাবস্থা করতে পারবে , এমন নিশ্চয়তা না থাকার কারণে উচ্চশিক্ষার প্রতি আগ্রহ কমছে৷

পশ্চিমবঙ্গ সরকারের গত পাঁচ বছরের স্টাফ সেনসাসে দেখা যাচ্ছে , রাজ্যে সরকারি কর্মচারীদের মধ্যে গড়ে ৫ শতাংশ মুসলমান৷ বেসরকারি সংগঠিত ক্ষেত্রেও মুসলমানদের অংশগ্রহণ খুব একটা আশাপ্রদ নয়৷ শিক্ষাক্ষেত্রে মুসলমানদের অংশগ্রহণ বাড়াতে , ওবিসি হিসাবে ১০ শতাংশ সংরক্ষণের সুযোগ থাকলেও , ভর্তির মরসুমে লক্ষ করা গেছে কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ কার্যত সংরক্ষণের নিয়ম নীতিকে বুড়ো আঙুল দেখাচ্ছে , এ বিষয়ে ভূরি ভূরি অভিযোগ উঠেছে৷ আশার কথা , উচ্চশিক্ষায় বিজ্ঞান , প্রযুক্তি , কারিগরি ও চিকিত্সাশাস্ত্রে মুসলমান ছেলেমেয়েদের অংশগ্রহণ গত এক দশকে লক্ষণীয় ভাবে বেড়েছে৷ যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের কথা ধরা যাক , মোট ৮৯ মুসলমান ছাত্রের মধ্যে ৬৬ জন অর্থাত্ ৭৫ শতাংশই বিজ্ঞান ও ইঞ্জিনিয়ারিং শাখায় পড়াশোনা করেন৷ রাজ্যের মেডিক্যাল কলেজ ও অন্যান্য ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে খানিকটা একই চিত্র দেখা যায়৷ সামগ্রিক ভাবে উচ্চশিক্ষায় মুসলমানদের আণুবীক্ষণিক উপস্থিতি নিয়ে কথা শুরু করলে , অনেকেই ধর্মীয় পরিচিতির বিচারে উচ্চশিক্ষায় অংশগ্রহণকে ব্যাখ্যা করার প্রবণতাকে সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি বলে দাবি করেন , তাঁদের মতে উচ্চশিক্ষায় মেধাই শেষ কথা৷ মেধায় যে খামতি নেই , তা উপরের তথ্যই পরিষ্কার করে দেয়৷ বিজ্ঞান ও ইঞ্জিনিয়ারিং শাখায় পড়াশুনা করা মুসলমানদের সাফল্য তাঁদের নিজেদের চেষ্টায়৷ মুসলমানদের জন্য সরকারি ও সংগঠিত ক্ষেত্রে ক্রমশ কাজের সুযোগ সংকুচিত হওয়ায় , এই সমাজে পেশাজীবী শিক্ষার প্রতি ঝোঁক লক্ষ করা যায়৷

আল -আমিন মিশন পেশাজীবী শিক্ষায় যাতে তারা সুযোগ পায় তার জন্য বিশেষ প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করে থাকে৷ অন্য দিকে , সমাজবিজ্ঞানের উচ্চশিক্ষায় মুসলমানদের অংশগ্রহণের একটা বড়ো বাধা ইংরেজি না -জানা৷ পশ্চিমবঙ্গের উচ্চশিক্ষায় ইংরেজি ভাষার প্রচলন আজও জোরদার , এ ক্ষেত্রে ইংরেজি জানাও প্রয়োজনীয় , অথচ গ্রামে বসবাসকারী ইংরেজি শিক্ষার সুযোগ -বঞ্চিত প্রজন্ম তার দরুণ ভুগছে৷ সমাজবিজ্ঞান পাঠে নিজের বক্তব্য জাহির করতে ইংরেজি জরুরি হয়ে পড়ে , অন্য দিকে বিজ্ঞান , প্রযুক্তি , কারিগরি শিক্ষায় অঙ্ক অনেকখানি এগিয়ে যেতে পারে৷ আর্থিক ভাবে অসচ্ছল পরিবারের অনেকেই প্রোফেশনাল কোর্সে পড়াশুনার জন্য সরকারি ও অসরকারি সংস্থা থেকে আর্থিক সাহায্য পাচ্ছেন ; রাজ্যের সংখ্যালঘু উন্নয়ন ও বিত্ত নিগমের বৃত্তি ও শিক্ষাঋণের কারণে , এবং শিল্পপতি মুস্তাক হোসেনের জি ডি একাডেমি ও স্ন্যাপ -এর মাধ্যমে দরিদ্র মুসলমান পরিবারের কিছু ছাত্র -ছাত্রী উচ্চশিক্ষার সুযোগ পাচ্ছে৷

স্বাধীনতার সত্তর বছর , সাচার কমিটি রিপোর্টের দশ বছর পরেও , উচ্চশিক্ষা প্রাঙ্গণে মুসলমানদের অকিঞ্চিত্কর উপস্থিতি গণতান্ত্রিক ভারতে সামাজিক ন্যায়ের পরাজয়৷ রাজ্যে মুসলমানদের ধর্মীয় পরিচিতির গণ্ডি ভেঙে আর্থ- সামাজিক ভাবে পশ্চাদপদ জনগোষ্ঠী হিসেবে বিবেচনা করে মুসলমানদের উন্নয়নের জন্য নীতি নির্ধারকরা নতুন করে ভাববেন যেন উচ্চশিক্ষায় উপযোগী মুসলমান ছেলেমেয়েরা আরও বেশি করে শিক্ষার সুযোগ পায় ?
লেখক প্রতীচী ট্রাস্টে কর্মরত

পরের খবর

Editorialসম্পর্কে আরও বিস্তারিত ও নতুন খবর জানতে ক্লিক করুন। সব ধরনের ব্রেকিং, আপডেট এবং বিশ্লেষণ সবার প্রথম বাংলায় পড়তে ক্লিক করুন Bengali Newsএই সময় ডিজিটাল