প্রশান্ত ভট্টাচার্য "মুঝে হিরা চাহিয়ে, মানিক নেহি।" ২০১৮ সালে ত্রিপুরার বিধানসভা নির্বাচনের (Tripura Assembly Election) প্রচারে এটাই ছিল প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর (PM Narendra Modi) ক্যাচলাইন। চার বছর তিন মাসের মাথায় সেই মানিককেই চাইলেন মোদী। তবে এ মানিক সরকার নয়, সাহা। আর ২০১৮-তে মোদী যে হিরের গল্প করেছিলেন, তা কার্বনের কোনও অ্যালট্রপি নয়, তা হল হিরা (HIRA)। এই HIRA মানে হাইওয়ে, আইওয়ে (ডিজিটাল যোগাযোগ), রোডওয়ে, এবং এয়ারওয়ে! সেই হিরার জন্য ভোটে জেতার পর মোদী-শাহরা ত্রিপুরার মুখ্যমন্ত্রী করেছিলেন আরএসএসের হাতে তৈরি বিপ্লব দেবকে। তাঁর শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানে দিল্লি থেকে আগরতলা উড়ে এসেছিলেন শীর্ষ নেতারা। মোদী-শাহর সঙ্গে মঞ্চে হাজির ছিলেন গেরুয়া শিবিরের মহারথীরা- লালকৃষ্ণ আদবানি থেকে শুরু করে রাজনাথ সিং (Rajnath Singh), মুরলী মনোহর জোশী, বিজয় রূপানি। সকলেই মঞ্চে উপস্থিত থেকে সেই 'বৈপ্লবিক' মুহূর্তের সাক্ষী হলেন। সারা দেশ দেখেছিল, শপথ নেওয়ার পর বিপ্লবের মোদীকে আলিঙ্গন করার দৃশ্য। দেখেছিল, এই বহিঃপ্রকাশে খোদ প্রধানমন্ত্রীর অস্বস্তিকর মুখব্যাদান। সেই বিপ্লবপর্ব এথন ইতি। শুরু হল মানিক 'সরকার'। অথচ কদিন আগেও বিপ্লব দেবের নেতৃত্বে ত্রিপুরাকে মডেল স্টেট করার কথা বলেছিলেন খোদ অমিত শাহ (Amit Shah)। ২০১৮-র আগে BJP-র কাছে রিপোর্ট এসেছিল, ত্রিপুরায় পরিবর্তনের হাওয়া চোরাগোপ্তা পথে খেলছে। ক্ষমতায় আসতে পারে BJP। এই রিপোর্ট পেয়েই উঠে পড়ে লাগে মোদী-শাহ জুটি। এবং সেই প্রচারের দাপট সামলাতে পারে না টানা দুই দশকের বাম শাসন। জয়ী BJP রাজ্যশাসনের ভার তুলে দেয় আরএসেসের কোলেপিঠে মানুষ বিপ্লব দেবের হাতে। ত্রিপুরায় বিপ্লবযুগের শুরু হয়। কিন্তু চার বছরও লাগল না, মোদীর মোহ ভেঙে গেল। বুঝলেন, হিরা আনতে গিয়ে তিনি গিরা দিয়ে ফেলেছেন। এই গিরা এবার খুলতে হবে। দলে গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব চরম রূপ নিয়েছে। BJPই হয়ে উঠেছে BJP-র শত্রু। এমনকী, সুদীপ রায় বর্মন দল ছেড়ে কংগ্রেসে যোগ দেওয়ার পরেও এই গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব কমার কোনও লক্ষণ নেই। এই অবস্থায় তৃণমূল কংগ্রেস ওখানে মাটি কামড়ে পড়ে রয়েছে। বাংলার অভিজ্ঞতা থেকে মোদী-শাহ জানেন, 'দিদি'র 'ভাইপো' প্লেয়ার হিসেবে কম নন। ওদিকে সিপিআইএম-কংগ্রেস জোট বাঁধাটা হলেও হয়ে যেতে পারে। তার ওপর আছে 'নো ভোট টু BJP'-ওয়ালারা। ভোটের আগে সময় থাকতে থাকতে বিপ্লবে লাগাম না পরালে কোথা দিয়ে যে কলি ঢুকে পড়বে, তা বোঝা মুশকিল। সেই কারণে পুরনো পথেই হাঁটলেন দীনদয়াল উপাধ্যায় মার্গের ম্যানেজাররা।
অতীতে নির্বাচনের আগে একাধিক রাজ্যে মুখ্যমন্ত্রী বদল করেছে BJP, তাতে সাফল্যও এসেছে। উত্তরাখণ্ড, কর্নাটক এবং গুজরাতে মুখ্যমন্ত্রী বদল করেছে BJP শীর্ষ নেতৃত্ব৷ অতএব বিপ্লবের ইতি। আয় মানিক আয়। একটু খেয়াল করলেই দেখা যায়, গেরুয়া শিবিরের এই সিদ্ধান্তটি বড়ই আকস্মিক। কেন না, মাত্র ৪০ দিন মানিক সাহা রাজ্যসভার সদস্য হয়েছেন। যদি BJP নেতৃত্বের আগে থেকেই ভাবনা-চিন্তা থাকত, বিপ্লব দেবকে সরিয়ে মানিককে আনবেন, তবে তাঁকে রাজ্যসভায় পাঠালেন কেন? যে মানুষটার সংসদীয় রাজনীতির কোনও অভিজ্ঞতা নেই, তাঁকেই বা মুখ্যমন্ত্রী করতে হল কেন? যেখানে বিপ্লবের মন্ত্রিসভায় একজন উপমুখ্যমন্ত্রী ছিলেনই, তখন কেন মানিকের খোঁজ? এক্ষেত্রে আমার একটা কথা মনে হচ্ছে, BJPকেও ত্রিপুরার মাটিতে মানিক নামটার ওপর ভরসা করতে হল। চার বছর আগে যে মোদী মানিক চাননি, প্রতিটি নির্বাচনী জনসভায় বলেছিলেন, "আর মানিক চাই না, এবার মানিক থেকে মুক্তি নিয়ে নিন।" এবার সেই মানিকেই মুক্তি খুঁজতে হচ্ছে মোদী-শাহকে। এই যে নামের জাগলারি শুরু হল, তা চলবে আগামী বিধানসভা নির্বাচন পর্যন্ত। আমার আরও একটি ধারণা, ত্রিপুরার বিধানসভা নির্বাচন এগিয়ে আনা হবে। মার্চ পর্যন্ত অপেক্ষা করবে না কেন্দ্র। মানিকের মুখ্যমন্ত্রী থাকার ৬ মাসের মধ্যেই বিধানসভা নির্বাচনে চলে যাবে BJP। এর ফলে মানিক সাহাকে কোনও উপনির্বাচন ফেস করতে হবে না।
তবে মানিক নামের জাদুকে কাজে লাগাতে গিয়ে কি BJP ত্রিপুরা রাজ্যে দলের অভ্যন্তরীণ কোন্দল মিনিমাইজ করতে পারবে? প্রশ্ন উঠেছে, দিল্লি BJP-র এই 'বৈপ্লবিক' সিদ্ধান্তে ত্রিপুরার BJP বাঁচবে তো? দলেরই একাংশ বলছে, এই বদল ঘটিয়ে কেন্দ্রীয় নেতারা ত্রিপুরায় BJP-র সাফল্য দেখতে চান? না কি, ত্রিপুরায় BJP-র প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী সিপিআইএম বা তৃণমূল কংগ্রেসের (TMC) পালে হাওয়া দিতেই মোদী-শাহ-নাড্ডারা পরিকল্পিত ভাবে নিজেদের নাক কেটে দেখালেন? ত্রিপুরার রাজনৈতিক মহলের অভিমত, ২০২৩-এর বিধানসভা নির্বাচনে গেরুয়া শিবিরের জয় নিশ্চিত ছিল, যা এখন প্রশ্নের মুখে পড়ল৷ বলা হচ্ছে, মুখ্যমন্ত্রী বদল করার ফলে কি বাড়তি অক্সিজেন পেল বিরোধীরা? নাকি দলে গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব জিইয়ে রাখা হল? রবিবার মানিক সাহার শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানে গরহাজির ছিলেন বিপ্লব দেব মন্ত্রিসভার একাধিক সদস্য ও একাধিক বিধায়ক। বিপ্লবের উপমুখ্যমন্ত্রী জিষ্ণু দেববর্মাকেও দেখা যায়নি। গরহাজিরের তালিকায় রয়েছেন মন্ত্রী রামপ্রসাদ পালও। মানিকের শপথের কিছু আগেই জিষ্ণু তাঁর টুইটার বায়ো থেকেও উপমুখ্যমন্ত্রী শব্দটি সরিয়ে দিয়েছেন। রেখেছেন শুধুমাত্র বিধায়ক পরিচয়টি। যদিও শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানের পরে জিষ্ণু দেববর্মা রাজভবনে উপস্থিত হয়েছিলেন। যে ভিডিওটি ভাইরাল হয়েছে, তাতে দেখা যাচ্ছে, শনিবার যখন ত্রিপুরার মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে মানিক সাহার নাম ঘোষণা করেছিলেন বিপ্লব দেব, তখনই তুমুল বিক্ষোভ শুরু হয়েছিল BJP-র অন্দরে। প্রকাশ্যেই ক্ষোভ প্রকাশ করেছিলেন মন্ত্রী রামপ্রসাদ পাল। চেয়ার ছোড়াছুড়িও হয়। BJP-র মতো রেজিমেন্টেড পার্টিতে এরকম বিক্ষোভ আনলাইক BJP। বিক্ষুব্ধদের দাবির মধ্যে আছে, মানিক সাহা ২০১৬ সালে কংগ্রেস থেকে BJPতে এসেছেন। সেই অর্থে তিনি নব্য BJP। আর হার্ডকোর বিপ্লব দেবের লোক, ফলে সেই তো বকলমে বিপ্লবশাসন। এছাড়া, বিক্ষুব্ধরা কি আদৌ জায়গা পাবেন মানিক সাহার নেতৃত্বাধীন মন্ত্রিসভায়? কয়েকজনের ভাগ্যে শিকে ছিঁড়লেও তাঁরা কি আর আগের মতো গুরুত্ব পাবেন? যদিও এই গুরুত্ব নিয়েই আলাদা আলোচনা করা যায়, কেন না, বিপ্লব দেবের বিরুদ্ধে তাঁর সাথীদের যতগুলো অভিযোগ আছে, তার অন্যতম হল সতীর্থদের গুরুত্ব না দেওয়া। এনিয়ে গত বছর আগরতলার বিধায়ক ও BJP নেতা সুদীপ রায় বর্মন (বর্তমানে কংগ্রেসে যোগ দিয়েছেন) বলেছিলেন, "আমাদের মুখ্যমন্ত্রী কারও সঙ্গে কনসাল্ট করেন না। বাকি মন্ত্রীদের ভ্যালু নেই। শুধু ওয়ান ম্যান ভয়েজ আছে। অফিসাররা তাঁর কথাই শুনছেন। তাহলে কে কী কাজ করবে!" একই সঙ্গে তাঁর অভিযোগ ছিল, "আমাদের যে ভিশন ডকুমেন্ট ছিল, তার ধারেকাছে নেই। কোনটা আগে, কোনটা পরে করতে হবে, তার মিনিমাম ধ্যানধারণা নেই।"
এইখানে আমি পাঠককে একটু কমিক রিলিফ দিতে চাই কয়েকটি বিপ্লবভাষ্য দিয়ে। যেমন -
১)হাঁস জলে সাঁতার কাটতে কাটতে অক্সিজেন ছাড়ে।
২) জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে রবীন্দ্রনাথ নোবেল পুরস্কার ফিরিয়ে দিয়েছিলেন।
৩) মহাভারতের সময়ে ইন্টারনেট ছিল।
৪) ডায়ানা হেডেনকে যতটা সুন্দরী বলা হয়, তিনি কিন্তু ততটা সুন্দরী নন।
৫) সিভিল ইঞ্জিনিয়াররা সিভিল সার্ভিসেস পরীক্ষায় বসতে পারবেন।
৬) মোদীর এক ভাই মুদি, আর এক ভাই অটোচালক।
৭) এবার BJP দখল করবে নেপাল এবং শ্রীলঙ্কা।
তবে মনে রাখবেন, এই বচনগুলোর জন্য মোদীরা বিপ্লবে অসন্তুষ্ট নন, এমন অদ্ভুত উক্তি BJP নেতা-মন্ত্রীরা এবেলা-ওবেলা করে থাকেন। গোরুর দুধে সোনার খোঁজ তো আমাদের রাজ্যে দিলীপ ঘোষও দিয়েছিলেন। এমন অলীকবচন BJP-র সর্বোচ্চ নেতাদের মুখেও উচ্চারিত হয়। আসল কথা, বিপ্লব দেবের বিরুদ্ধে প্রধান তিনটি অভিযোগ উঠেছিল। নিজের মতো করে সরকার চালানো, দলের কোনও নেতার কথা না শোনা। সবাইকে নিয়ে চলতে না পারা। ত্রিপুরায় BJP-র জোটসঙ্গী Indigenous Peoples Front of Tripura’র (IPFT) তরফেও বিপ্লব দেবের ভূমিকায় অসন্তোষ প্রকাশ করা হয়। এই 'বিপ্লবী' আচরণ নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে ত্রিপুরার মুখ্যমন্ত্রী বিপ্লব দেবের বিরুদ্ধে সরব ত্রিপুরার মন্ত্রী ও BJP বিধায়কদের এক বড় অংশ। একাধিকবার প্রকাশ্যেও এমন অভিযোগ সামনে এসেছে। কিন্তু আইপিএফটি? ত্রিপুরায় ক্ষমতায় ফিরতে গেলে আদিবাসী ভোট ব্যাঙ্ক ধরে রাখা BJP-র কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ রাজ পরিবারের প্রদ্যুৎকিশোর দেববর্মার দল টিপরা মোথ-ও আদিবাসী অধ্যুষিত বিধানসভাগুলিকে টার্গেট করছে। কিছুদিন আগেই আইপিএফটি-র উদ্দেশে প্রদ্যুৎকিশোর আহ্বান জানিয়েছেন, "আমি IPFT-র কাছে আবেদন করছি । তাঁরা যেন সামান্য যা দূরত্ব আছে তা মিটিয়ে আমাদের সঙ্গে যোগ দেন। আমরা একই লক্ষ্য নিয়ে লড়াই করছি। তাই বৃহত্তর স্বার্থে উচিত সব বিরোধ ভুলে একটি দল হয়ে লড়াই করার। কারণ আমরা Tiprasa মানুষের সাংবিধানিক অধিকারের জন্য লড়াই করছি।"
এই পরিস্থিতিতে বিপ্লবের ওপর ভরসা রাখা শাহদের পক্ষে চিন্তার ছিল। ততদিনে ত্রিপুরা নিয়ে BJP-র কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের করা অভ্যন্তরীণ তদন্ত রিপোর্ট মোদী-শাহদের হাতে এসে যায়। নেতারা বুঝে যান, কোনও শিথিলতা নয়, কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে হবে। তড়িঘড়ি দিল্লিতে ডাক পড়ে বিপ্লব দেবের। মোদীর হিরা থেকে দ্যুতি ঝলকায় না, মোতি খসে পড়ে। অতএব, বাই বাই বিপ্লব!
(এই প্রবন্ধে প্রকাশিত মতামত সম্পূর্ণ ভাবে লেখকের ব্যক্তিগত। এই সময় ডিজিটাল কোনও ভাবেই লেখার দায়ভার বহন করে না।)
অতীতে নির্বাচনের আগে একাধিক রাজ্যে মুখ্যমন্ত্রী বদল করেছে BJP, তাতে সাফল্যও এসেছে। উত্তরাখণ্ড, কর্নাটক এবং গুজরাতে মুখ্যমন্ত্রী বদল করেছে BJP শীর্ষ নেতৃত্ব৷ অতএব বিপ্লবের ইতি। আয় মানিক আয়। একটু খেয়াল করলেই দেখা যায়, গেরুয়া শিবিরের এই সিদ্ধান্তটি বড়ই আকস্মিক। কেন না, মাত্র ৪০ দিন মানিক সাহা রাজ্যসভার সদস্য হয়েছেন। যদি BJP নেতৃত্বের আগে থেকেই ভাবনা-চিন্তা থাকত, বিপ্লব দেবকে সরিয়ে মানিককে আনবেন, তবে তাঁকে রাজ্যসভায় পাঠালেন কেন? যে মানুষটার সংসদীয় রাজনীতির কোনও অভিজ্ঞতা নেই, তাঁকেই বা মুখ্যমন্ত্রী করতে হল কেন? যেখানে বিপ্লবের মন্ত্রিসভায় একজন উপমুখ্যমন্ত্রী ছিলেনই, তখন কেন মানিকের খোঁজ? এক্ষেত্রে আমার একটা কথা মনে হচ্ছে, BJPকেও ত্রিপুরার মাটিতে মানিক নামটার ওপর ভরসা করতে হল। চার বছর আগে যে মোদী মানিক চাননি, প্রতিটি নির্বাচনী জনসভায় বলেছিলেন, "আর মানিক চাই না, এবার মানিক থেকে মুক্তি নিয়ে নিন।" এবার সেই মানিকেই মুক্তি খুঁজতে হচ্ছে মোদী-শাহকে। এই যে নামের জাগলারি শুরু হল, তা চলবে আগামী বিধানসভা নির্বাচন পর্যন্ত। আমার আরও একটি ধারণা, ত্রিপুরার বিধানসভা নির্বাচন এগিয়ে আনা হবে। মার্চ পর্যন্ত অপেক্ষা করবে না কেন্দ্র। মানিকের মুখ্যমন্ত্রী থাকার ৬ মাসের মধ্যেই বিধানসভা নির্বাচনে চলে যাবে BJP। এর ফলে মানিক সাহাকে কোনও উপনির্বাচন ফেস করতে হবে না।
তবে মানিক নামের জাদুকে কাজে লাগাতে গিয়ে কি BJP ত্রিপুরা রাজ্যে দলের অভ্যন্তরীণ কোন্দল মিনিমাইজ করতে পারবে? প্রশ্ন উঠেছে, দিল্লি BJP-র এই 'বৈপ্লবিক' সিদ্ধান্তে ত্রিপুরার BJP বাঁচবে তো? দলেরই একাংশ বলছে, এই বদল ঘটিয়ে কেন্দ্রীয় নেতারা ত্রিপুরায় BJP-র সাফল্য দেখতে চান? না কি, ত্রিপুরায় BJP-র প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী সিপিআইএম বা তৃণমূল কংগ্রেসের (TMC) পালে হাওয়া দিতেই মোদী-শাহ-নাড্ডারা পরিকল্পিত ভাবে নিজেদের নাক কেটে দেখালেন? ত্রিপুরার রাজনৈতিক মহলের অভিমত, ২০২৩-এর বিধানসভা নির্বাচনে গেরুয়া শিবিরের জয় নিশ্চিত ছিল, যা এখন প্রশ্নের মুখে পড়ল৷ বলা হচ্ছে, মুখ্যমন্ত্রী বদল করার ফলে কি বাড়তি অক্সিজেন পেল বিরোধীরা? নাকি দলে গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব জিইয়ে রাখা হল? রবিবার মানিক সাহার শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানে গরহাজির ছিলেন বিপ্লব দেব মন্ত্রিসভার একাধিক সদস্য ও একাধিক বিধায়ক। বিপ্লবের উপমুখ্যমন্ত্রী জিষ্ণু দেববর্মাকেও দেখা যায়নি। গরহাজিরের তালিকায় রয়েছেন মন্ত্রী রামপ্রসাদ পালও। মানিকের শপথের কিছু আগেই জিষ্ণু তাঁর টুইটার বায়ো থেকেও উপমুখ্যমন্ত্রী শব্দটি সরিয়ে দিয়েছেন। রেখেছেন শুধুমাত্র বিধায়ক পরিচয়টি। যদিও শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানের পরে জিষ্ণু দেববর্মা রাজভবনে উপস্থিত হয়েছিলেন। যে ভিডিওটি ভাইরাল হয়েছে, তাতে দেখা যাচ্ছে, শনিবার যখন ত্রিপুরার মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে মানিক সাহার নাম ঘোষণা করেছিলেন বিপ্লব দেব, তখনই তুমুল বিক্ষোভ শুরু হয়েছিল BJP-র অন্দরে। প্রকাশ্যেই ক্ষোভ প্রকাশ করেছিলেন মন্ত্রী রামপ্রসাদ পাল। চেয়ার ছোড়াছুড়িও হয়। BJP-র মতো রেজিমেন্টেড পার্টিতে এরকম বিক্ষোভ আনলাইক BJP। বিক্ষুব্ধদের দাবির মধ্যে আছে, মানিক সাহা ২০১৬ সালে কংগ্রেস থেকে BJPতে এসেছেন। সেই অর্থে তিনি নব্য BJP। আর হার্ডকোর বিপ্লব দেবের লোক, ফলে সেই তো বকলমে বিপ্লবশাসন। এছাড়া, বিক্ষুব্ধরা কি আদৌ জায়গা পাবেন মানিক সাহার নেতৃত্বাধীন মন্ত্রিসভায়? কয়েকজনের ভাগ্যে শিকে ছিঁড়লেও তাঁরা কি আর আগের মতো গুরুত্ব পাবেন? যদিও এই গুরুত্ব নিয়েই আলাদা আলোচনা করা যায়, কেন না, বিপ্লব দেবের বিরুদ্ধে তাঁর সাথীদের যতগুলো অভিযোগ আছে, তার অন্যতম হল সতীর্থদের গুরুত্ব না দেওয়া। এনিয়ে গত বছর আগরতলার বিধায়ক ও BJP নেতা সুদীপ রায় বর্মন (বর্তমানে কংগ্রেসে যোগ দিয়েছেন) বলেছিলেন, "আমাদের মুখ্যমন্ত্রী কারও সঙ্গে কনসাল্ট করেন না। বাকি মন্ত্রীদের ভ্যালু নেই। শুধু ওয়ান ম্যান ভয়েজ আছে। অফিসাররা তাঁর কথাই শুনছেন। তাহলে কে কী কাজ করবে!" একই সঙ্গে তাঁর অভিযোগ ছিল, "আমাদের যে ভিশন ডকুমেন্ট ছিল, তার ধারেকাছে নেই। কোনটা আগে, কোনটা পরে করতে হবে, তার মিনিমাম ধ্যানধারণা নেই।"
এইখানে আমি পাঠককে একটু কমিক রিলিফ দিতে চাই কয়েকটি বিপ্লবভাষ্য দিয়ে। যেমন -
১)হাঁস জলে সাঁতার কাটতে কাটতে অক্সিজেন ছাড়ে।
২) জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে রবীন্দ্রনাথ নোবেল পুরস্কার ফিরিয়ে দিয়েছিলেন।
৩) মহাভারতের সময়ে ইন্টারনেট ছিল।
৪) ডায়ানা হেডেনকে যতটা সুন্দরী বলা হয়, তিনি কিন্তু ততটা সুন্দরী নন।
৫) সিভিল ইঞ্জিনিয়াররা সিভিল সার্ভিসেস পরীক্ষায় বসতে পারবেন।
৬) মোদীর এক ভাই মুদি, আর এক ভাই অটোচালক।
৭) এবার BJP দখল করবে নেপাল এবং শ্রীলঙ্কা।
তবে মনে রাখবেন, এই বচনগুলোর জন্য মোদীরা বিপ্লবে অসন্তুষ্ট নন, এমন অদ্ভুত উক্তি BJP নেতা-মন্ত্রীরা এবেলা-ওবেলা করে থাকেন। গোরুর দুধে সোনার খোঁজ তো আমাদের রাজ্যে দিলীপ ঘোষও দিয়েছিলেন। এমন অলীকবচন BJP-র সর্বোচ্চ নেতাদের মুখেও উচ্চারিত হয়। আসল কথা, বিপ্লব দেবের বিরুদ্ধে প্রধান তিনটি অভিযোগ উঠেছিল। নিজের মতো করে সরকার চালানো, দলের কোনও নেতার কথা না শোনা। সবাইকে নিয়ে চলতে না পারা। ত্রিপুরায় BJP-র জোটসঙ্গী Indigenous Peoples Front of Tripura’র (IPFT) তরফেও বিপ্লব দেবের ভূমিকায় অসন্তোষ প্রকাশ করা হয়। এই 'বিপ্লবী' আচরণ নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে ত্রিপুরার মুখ্যমন্ত্রী বিপ্লব দেবের বিরুদ্ধে সরব ত্রিপুরার মন্ত্রী ও BJP বিধায়কদের এক বড় অংশ। একাধিকবার প্রকাশ্যেও এমন অভিযোগ সামনে এসেছে। কিন্তু আইপিএফটি? ত্রিপুরায় ক্ষমতায় ফিরতে গেলে আদিবাসী ভোট ব্যাঙ্ক ধরে রাখা BJP-র কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ রাজ পরিবারের প্রদ্যুৎকিশোর দেববর্মার দল টিপরা মোথ-ও আদিবাসী অধ্যুষিত বিধানসভাগুলিকে টার্গেট করছে। কিছুদিন আগেই আইপিএফটি-র উদ্দেশে প্রদ্যুৎকিশোর আহ্বান জানিয়েছেন, "আমি IPFT-র কাছে আবেদন করছি । তাঁরা যেন সামান্য যা দূরত্ব আছে তা মিটিয়ে আমাদের সঙ্গে যোগ দেন। আমরা একই লক্ষ্য নিয়ে লড়াই করছি। তাই বৃহত্তর স্বার্থে উচিত সব বিরোধ ভুলে একটি দল হয়ে লড়াই করার। কারণ আমরা Tiprasa মানুষের সাংবিধানিক অধিকারের জন্য লড়াই করছি।"
এই পরিস্থিতিতে বিপ্লবের ওপর ভরসা রাখা শাহদের পক্ষে চিন্তার ছিল। ততদিনে ত্রিপুরা নিয়ে BJP-র কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের করা অভ্যন্তরীণ তদন্ত রিপোর্ট মোদী-শাহদের হাতে এসে যায়। নেতারা বুঝে যান, কোনও শিথিলতা নয়, কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে হবে। তড়িঘড়ি দিল্লিতে ডাক পড়ে বিপ্লব দেবের। মোদীর হিরা থেকে দ্যুতি ঝলকায় না, মোতি খসে পড়ে। অতএব, বাই বাই বিপ্লব!
(এই প্রবন্ধে প্রকাশিত মতামত সম্পূর্ণ ভাবে লেখকের ব্যক্তিগত। এই সময় ডিজিটাল কোনও ভাবেই লেখার দায়ভার বহন করে না।)