১৯৭০ এর দশকের কলকাতায় বেড়ে ওঠার অনিবার্য ফল হিসাবে বাংলার সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার আমাকে আপাদমস্তক প্রভাবিত করেছিল। বাঙালি সংস্কৃতির পীঠস্থান কলকাতায় বেড়ে ওঠার সুবাদে আর পাঁচজন বাঙালি ছেলেমেয়ের মতোই বাংলা শিল্প সংস্কৃতির প্রেমে পড়েছিলাম অবাঙালি হওয়া সত্ত্বেও।
আর যখন কৈশোরের শেষ প্রান্তে পৌঁছলাম, ততদিনে ফেলূ মিত্তির আমার শয়নে স্বপনে। বাংলা চলচ্চিত্রের আইকন সৌমিত্র চ্যাটার্জির আন্তর্জাতিক মানের অভিনয় তখন হাজার হাজার বাঙালির মতো আমারও মন কেড়েছে। তখন আমি আমার অনুপ্রেরণা সৌমিত্র চ্যাটার্জির পদাঙ্ক অনুসরণ করতে উদগ্রীব। তিনি একাধারে অভিনেতা, কবি, আবৃত্তি শিল্পী, নাট্যকার এবং বাংলা চলচ্চিত্র কে বিশ্বের দরবারে পৌঁছে দেবার অন্যতম প্রধান কান্ডারী।
১৯৯০ সালের আগস্ট মাসের মাঝামাঝি কলকাতার ভ্যাপসা গরমের এক সকালে গলদঘর্ম আমি সৌমিত্রদার গল্গগ্রীনের বাড়ির সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম।
একটা কালো লোহার গেট হাট করে খোলা ছিল। সেই গেট দিয়ে ঢুকে আমি একটা লনে গিয়ে পৌঁছলাম। সেখানে একটা টিপয় আর কয়েকটা চেয়ার ছিল। ঐ এক টুকরো সবুজের ওপারেই বাড়ির সদর দরজা।
আমি এগিয়ে গিয়ে দরজার বেলটা বাজালাম, আর সঙ্গে সঙ্গে বুকের ভেতর ধুকপুক করতে লাগল। আমাদের ফেলুদা ভিতরে আছেন তো? আমার সাথে দেখা করতে চাইবেন কি? আমি, কলেজের ফার্স্ট ইয়ারের একজন অতি সাধারন ছাত্র, কোন অ্যাপয়েন্টমেন্ট ছাড়াই দেখা করতে চলে এসেছি । এতে কেমন প্রতিক্রিয়া হবে ওঁর? এসব নানা ভাবনার মাঝেই দরজাটা খুলল। খুলতেই দেখি আমার স্বপ্নের নায়ক স্বয়ং আমার সামনে দাঁড়িয়ে! প্রায় ছ ফুট লম্বা, টকটকে গায়ের রং আর এক অনির্বচনীয় জ্যোতি নিয়ে সৌমিত্র চ্যাটার্জি নিজে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে আমার থেকে বড়জোর এক ফুট দূরে দাঁড়িয়ে।
“কাকে চান?” সহজাত ভঙ্গিতে তাঁর প্রথম জিজ্ঞাসা।
এই বিশাল ব্যক্তিত্বের সামনে কিছুক্ষণ আমি বাকরুদ্ধ। খানিকটা সামলে নিয়ে সৌমিত্রদাকে গড়গড় করে বলে গেলাম যে আমি ওঁর অন্ধ ভক্ত, সুরেন্দ্রনাথ কলেজে গ্র্যাজুয়েশন করছি, আর মনপ্রাণ দিয়ে অভিনয় শিখতে চাই। কথাগুলো শেষ হতেই ভাবলাম, সৌমিত্রদা নিশ্চই মুখের উপর দরজাটা বন্ধ করে দেবেন।--- আমি অন্তত এরকম কিছুর জন্যই তৈরি ছিলাম। কিন্তু উনি তা না করে মাথাটা একটু নাড়লেন, তারপর আমাকে লনের চেয়ারে বসতে বললেন।
আমি বললাম যে ওঁর অনেক ছবি দেখেছি। ওঁর বহুমুখী প্রতিভা, অভিনয়ের বিস্তার আর দক্ষতা আমাকে বাকরুদ্ধ করে দেয়। সোনার কেল্লা আর জয়বাবা ফেলুনাথ ছবির ঝানু গোয়েন্দা ফেলুদাই হোক, আর শাখা প্রশাখা ছবির আত্মমগ্ন প্রশান্ত, যার প্রায় কোন সংলাপই নেই --- তিনি সব চরিত্রেই কি দারুণ অভিনয় করেছেন! আমি প্রবল উৎসাহে একগাদা কথা বলে গেলাম। সৌমিত্রদা পুরোটাই মন দিয়ে শুনলেন। দেখলাম মাঝে মাঝে তাঁর উজ্জ্বল, সুন্দর মুখে মৃদু হাসির ঝিলিক।
কিন্তু সত্যিকারের মহান মানুষরা যেমন হন, সৌমিত্রদা নিজের ব্যাপারে আগ্রহী ছিলেন না। তাঁর বেশি আগ্রহ তিনি যার সাথে কথা বলছিলেন তাকে নিয়ে --- মানে আমাকে নিয়ে!
একেবারে অভিভাবক সুলভ ভঙ্গিতে জানালেন, আমার প্রথম কাজ হচ্ছে পড়াশোনা শেষ করা। “তোমাকে আগে লেখাপড়া শেষ করতে হবে। ওখানে আপোষ করা চলবে না বাবা। পড়াশোনার পাশাপাশি তুমি থিয়েটার করতে পারো, অভিনয়ের প্রতি তোমার যে প্যাশন সেটার পিছনে সময় দিতে পারো।”
তারপর উনি সিনেমা আর থিয়েটারের অভিনয় নিয়ে কথা বললেন। এমন একটা ভাষায় কথাগুলো বললেন যেটা বুঝতে সহজ এবং দারুণ প্রেরণাদায়ক। এক কথায় বললে, উনি ভীষণ উৎসাহ দিলেন আর আমি সবটা চেটেপুটে নিলাম।
সৌমিত্রদা আমাকে বিখ্যাত থিয়েটার ব্যক্তিত্ব বিভাস চক্রবর্তীর সাথে দেখা করতে বললেন, অভিনয় শিল্পটা শেখার জন্য। বললেন “বিভাসদাকে বলবে আমি তোমাকে পাঠিয়েছি।”
অভিনয়ের স্বপ্ন আমার স্বপ্নই রয়ে গেল। অনেকগুলো কারণে আমি সৌমিত্রদার দেখানো পথে হাঁটতে পারিনি। সেই কারণগুলো এতদিন পরে বলার পক্ষে খুব জটিল। কিন্তু আজও, এই তিরিশ বছর পরেও, এই কিংবদন্তীর দেওয়া একটা শিক্ষা আমি মনে রাখি: একজন উষ্ণ, সহজলভ্য, আন্তরিক, খাঁটি মানুষ হওয়ার শিক্ষা।
আমি শেষ পর্যন্ত যে পেশা বেছে নিয়েছিলাম সেটা থিয়েটার আর সিনেমার থেকে একেবারে অন্যরকম কিন্তু সৌমিত্রদার দেওয়া জীবনের পাঠ আমাকে আজও পথ দেখায়। ওটাই আমাদের সময়ের অন্যতম মহান ব্যক্তিত্বের কাছ থেকে পাওয়া আমার শ্রেষ্ঠ উপহার।
- স্মৃতিচারণায় যুবরাজ মেহতা, প্রধান, কর্পোরেট ব্র্যান্ড ম্যানেজমেন্ট এন্ড কমিউনিকেশন , এল এন্ড টি
আর যখন কৈশোরের শেষ প্রান্তে পৌঁছলাম, ততদিনে ফেলূ মিত্তির আমার শয়নে স্বপনে। বাংলা চলচ্চিত্রের আইকন সৌমিত্র চ্যাটার্জির আন্তর্জাতিক মানের অভিনয় তখন হাজার হাজার বাঙালির মতো আমারও মন কেড়েছে। তখন আমি আমার অনুপ্রেরণা সৌমিত্র চ্যাটার্জির পদাঙ্ক অনুসরণ করতে উদগ্রীব। তিনি একাধারে অভিনেতা, কবি, আবৃত্তি শিল্পী, নাট্যকার এবং বাংলা চলচ্চিত্র কে বিশ্বের দরবারে পৌঁছে দেবার অন্যতম প্রধান কান্ডারী।
১৯৯০ সালের আগস্ট মাসের মাঝামাঝি কলকাতার ভ্যাপসা গরমের এক সকালে গলদঘর্ম আমি সৌমিত্রদার গল্গগ্রীনের বাড়ির সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম।
একটা কালো লোহার গেট হাট করে খোলা ছিল। সেই গেট দিয়ে ঢুকে আমি একটা লনে গিয়ে পৌঁছলাম। সেখানে একটা টিপয় আর কয়েকটা চেয়ার ছিল। ঐ এক টুকরো সবুজের ওপারেই বাড়ির সদর দরজা।
আমি এগিয়ে গিয়ে দরজার বেলটা বাজালাম, আর সঙ্গে সঙ্গে বুকের ভেতর ধুকপুক করতে লাগল। আমাদের ফেলুদা ভিতরে আছেন তো? আমার সাথে দেখা করতে চাইবেন কি? আমি, কলেজের ফার্স্ট ইয়ারের একজন অতি সাধারন ছাত্র, কোন অ্যাপয়েন্টমেন্ট ছাড়াই দেখা করতে চলে এসেছি । এতে কেমন প্রতিক্রিয়া হবে ওঁর? এসব নানা ভাবনার মাঝেই দরজাটা খুলল। খুলতেই দেখি আমার স্বপ্নের নায়ক স্বয়ং আমার সামনে দাঁড়িয়ে! প্রায় ছ ফুট লম্বা, টকটকে গায়ের রং আর এক অনির্বচনীয় জ্যোতি নিয়ে সৌমিত্র চ্যাটার্জি নিজে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে আমার থেকে বড়জোর এক ফুট দূরে দাঁড়িয়ে।
“কাকে চান?” সহজাত ভঙ্গিতে তাঁর প্রথম জিজ্ঞাসা।
এই বিশাল ব্যক্তিত্বের সামনে কিছুক্ষণ আমি বাকরুদ্ধ। খানিকটা সামলে নিয়ে সৌমিত্রদাকে গড়গড় করে বলে গেলাম যে আমি ওঁর অন্ধ ভক্ত, সুরেন্দ্রনাথ কলেজে গ্র্যাজুয়েশন করছি, আর মনপ্রাণ দিয়ে অভিনয় শিখতে চাই। কথাগুলো শেষ হতেই ভাবলাম, সৌমিত্রদা নিশ্চই মুখের উপর দরজাটা বন্ধ করে দেবেন।--- আমি অন্তত এরকম কিছুর জন্যই তৈরি ছিলাম। কিন্তু উনি তা না করে মাথাটা একটু নাড়লেন, তারপর আমাকে লনের চেয়ারে বসতে বললেন।
আমি বললাম যে ওঁর অনেক ছবি দেখেছি। ওঁর বহুমুখী প্রতিভা, অভিনয়ের বিস্তার আর দক্ষতা আমাকে বাকরুদ্ধ করে দেয়। সোনার কেল্লা আর জয়বাবা ফেলুনাথ ছবির ঝানু গোয়েন্দা ফেলুদাই হোক, আর শাখা প্রশাখা ছবির আত্মমগ্ন প্রশান্ত, যার প্রায় কোন সংলাপই নেই --- তিনি সব চরিত্রেই কি দারুণ অভিনয় করেছেন! আমি প্রবল উৎসাহে একগাদা কথা বলে গেলাম। সৌমিত্রদা পুরোটাই মন দিয়ে শুনলেন। দেখলাম মাঝে মাঝে তাঁর উজ্জ্বল, সুন্দর মুখে মৃদু হাসির ঝিলিক।
কিন্তু সত্যিকারের মহান মানুষরা যেমন হন, সৌমিত্রদা নিজের ব্যাপারে আগ্রহী ছিলেন না। তাঁর বেশি আগ্রহ তিনি যার সাথে কথা বলছিলেন তাকে নিয়ে --- মানে আমাকে নিয়ে!
একেবারে অভিভাবক সুলভ ভঙ্গিতে জানালেন, আমার প্রথম কাজ হচ্ছে পড়াশোনা শেষ করা। “তোমাকে আগে লেখাপড়া শেষ করতে হবে। ওখানে আপোষ করা চলবে না বাবা। পড়াশোনার পাশাপাশি তুমি থিয়েটার করতে পারো, অভিনয়ের প্রতি তোমার যে প্যাশন সেটার পিছনে সময় দিতে পারো।”
তারপর উনি সিনেমা আর থিয়েটারের অভিনয় নিয়ে কথা বললেন। এমন একটা ভাষায় কথাগুলো বললেন যেটা বুঝতে সহজ এবং দারুণ প্রেরণাদায়ক। এক কথায় বললে, উনি ভীষণ উৎসাহ দিলেন আর আমি সবটা চেটেপুটে নিলাম।
সৌমিত্রদা আমাকে বিখ্যাত থিয়েটার ব্যক্তিত্ব বিভাস চক্রবর্তীর সাথে দেখা করতে বললেন, অভিনয় শিল্পটা শেখার জন্য। বললেন “বিভাসদাকে বলবে আমি তোমাকে পাঠিয়েছি।”
অভিনয়ের স্বপ্ন আমার স্বপ্নই রয়ে গেল। অনেকগুলো কারণে আমি সৌমিত্রদার দেখানো পথে হাঁটতে পারিনি। সেই কারণগুলো এতদিন পরে বলার পক্ষে খুব জটিল। কিন্তু আজও, এই তিরিশ বছর পরেও, এই কিংবদন্তীর দেওয়া একটা শিক্ষা আমি মনে রাখি: একজন উষ্ণ, সহজলভ্য, আন্তরিক, খাঁটি মানুষ হওয়ার শিক্ষা।
আমি শেষ পর্যন্ত যে পেশা বেছে নিয়েছিলাম সেটা থিয়েটার আর সিনেমার থেকে একেবারে অন্যরকম কিন্তু সৌমিত্রদার দেওয়া জীবনের পাঠ আমাকে আজও পথ দেখায়। ওটাই আমাদের সময়ের অন্যতম মহান ব্যক্তিত্বের কাছ থেকে পাওয়া আমার শ্রেষ্ঠ উপহার।
- স্মৃতিচারণায় যুবরাজ মেহতা, প্রধান, কর্পোরেট ব্র্যান্ড ম্যানেজমেন্ট এন্ড কমিউনিকেশন , এল এন্ড টি