রঞ্জন রায়
বহু দিন পরে আমরা ‘জগৎসভায় শ্রেষ্ঠ আসন’ পেয়েছি। দৈনিক করোনা আক্রান্তের ডেটা কয়েক সপ্তাহ আগে ৪ লাখ পেরিয়ে গেছল, এখন প্রায় একলাখ কমলেও চার্টের শীর্ষে আমরাই আছি। মৃত্যু সংখ্যা ২.৫ লাখ ছাড়িয়েছে। এখন গোটা দেশে কাশ্মীর থেকে বঙ্গ পর্য্যন্ত অনেকগুলো রাজ্যে আছড়ে পড়েছে লকডাউনের জলধিতরঙ্গ। গত বছর চারঘন্টার নোটিসে গোটা দেশে লকডাউনের ঘোষণা করেছিলেন দেশের প্রধানসেবক স্বয়ং। এবার দায়িত্বটা চাপিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রীদের ঘাড়ে।তখন উনি বলেছিলেন— মহাভারতে ১৮ দিনের ধর্মযুদ্ধে কৌরব সেনা ধ্বংস হল, অধর্মের পরাজয় হল। তোমরা আমাকে ২১টা দিন দাও, দেখ আমি কেমন করোনাকে ধ্বংস করি।
লোকে বিশ্বাস করল, শাঁখ ফুঁকে থালা বাজিয়ে নিষ্প্রদীপ করে ধর্মযুদ্ধ শুরু হল, ২১ দিন নব্বই দিনে গড়াল, কিন্তু আজও করোনা হারেনি।মনে হচ্ছে এ লড়াই চলছে, চলবে। অতএব ভাবা দরকার্ করোনা মহামারীর সংক্রমণ ঠেকাতে লকডাউন কোন স্থায়ী বা লাভজনক পদক্ষেপ কিনা। লকডাউন কার জন্যে?
প্রশ্ন ওঠে -লকডাউন কার জন্যে? কেন, সবার জন্যে। সবার প্রাণ বাঁচবে। তাই কি? বায়ুবাহিত সংক্রমণের হাত থেকে বাঁচতে ঘরের মধ্যে বন্ধ থাকার নিদান। কিন্তু যার ঘর নেই? আমি ফুটপাথবাসীদের কথা বলছিনা।আমি বলছি তাদের কথা যারা ভাড়ার বাড়িতে মাথা গুঁজে থাকে।এবং যারা ভিনরাজ্যে থেকে বা গ্রাম থেকে রুটি রুজির খোঁজে মহানগরে বা জেলা সদরে এসেছে। বলছি এ জন্যে যে ভারতের শ্রমশক্তির ৯০% হোল ইনফর্মাল লেবার বা অনিয়মিত শ্রমিক।
তারা কোথায় যাবে? যাবে কেন? যেখানে ছিল সেখানেই দাঁতে দাঁত চেপে পনেরটা দিন কাটিয়ে দেবে। পনেরটা দিন? কোন গ্যারান্টি আছে?গতবছরের অভিজ্ঞতার জমাখরচ সবার আগে বলা দরকার যে লকডাউন হলেও হাসপাতালের ডাক্তার, নার্স, ওয়ার্ডবয়, কেমিস্ট এবং অ্যাম্বুল্যান্স চালকদের প্রাণ হাতে করেও ঘর থেকে বেরোতে হবে। এর পর পুলিশ ও ব্যাংক কর্মচারিদের নম্বর। কিন্তু অন্যেরা? গত মার্চের লকডাউনে কাজ হারিয়েছে বিভিন্ন মতে প্রায় ৫০ থেকে ১২০ মিলিয়ন লোক। এদের উপর নির্ভরশীল পরিবার দ্রুত গরীবি রেখার নীচে নেমে যাচ্ছে। এরা জিরো-ইনকাম গ্রুপ থেকে কবে লোয়ার ইনকাম গ্রুপে ফিরবে আন্দাজ করা কঠিন।
আমরা সবাই জানি যে গতবারের লকডাউনের ফলে মার খেয়েছে গোটা অর্থব্যবস্থা, জিডিপি আগের বারের (+)৪% থেকে (-)৭% এ নেমে এসেছে। আনএমপ্লয়মেন্ট বা বেকারত্বের হার মার্চ’ ২০২০এর ৬.৫% থেকে বেড়ে সাময়িক ভাবে ২৩% ছাড়িয়ে গেছল। মার খেল ছোট ছোট দোকান, ছোট কারখানা, পরিষেবার ছোট প্রতিষ্ঠানগুলো।লকডাউন শুরু হওয়ার পর সবচেয়ে মার খেয়েছে খেলাধূলো, বিনোদন শিল্প এবং ট্যুরিজম ও হসপিটালিটি ব্যবসায়।
এদের সঙ্গে যুক্ত যে শ্রমিকেরা তাদের বেশিরভাগ অনিয়মিত রোজগারের, যেমন পিস রেটে বা দৈনিক মজুরিতে অলিখিত মৌখিক চুক্তির ভিত্তিতে কাজ করেন। তাঁরা অনেকেই মাইনে পান সপ্তাহান্তে বা মাসের শেষে। লকডাউনের ফলে উৎপাদিত পণ্যের ক্রেতা এবং পরিষেবার গ্রাহক ঘর থেকে না বেরোলে মালিকের আমদানি কমল। ফলে তাদের সোজা সমাধান হোল এই অনিয়মিত শ্রমিকদের আংশিক পারিশ্রমিক দেওয়া বা কিছুই না দেওয়া, খালি আশ্বাসন দেয়া যে সব কিছু আগেরমত হয়ে গেলে তাদের আবার কাজে ফিরিয়ে নেওয়া হবে এবং তখন বকায়া মজুরি চুকিয়ে দেওয়া হবে।
কিন্তু ততদিন? বাড়িওলা বকেয়া ভাড়া না দিলে ঘর খালি করতে বলছে। আর খাওয়ার জোগাড়? এরপর যাদের বৌ-বাচ্চা আছে তাদের তো গোদের উপর বিষফোঁড়া। এই মানুষেরা কারা? কী তাদের জীবিকা? এঁরা হলেন রাজমিস্ত্রি, ইলেক্ট্রিক মিস্ত্রি, প্লাম্বার, এসি এবং টিভি সারাইয়ের মিস্ত্রি, চুলকাটার নাপিত, স্থানীয় দুধওলা, মাছওলা, সব্জিওলা। এঁরা রিকশা টানেন, টোটো এবং অটো চালান; এঁরা কাজের মাসি। এঁরা বিউটি পার্লারে কাজ করেন, এঁরা ছোটখাটো জিনিস বিক্রি করেন, দোকানে সেলস ও ফাইফরমাশ খাটার কাজ করেন। এঁরা বড় শহরে বহুতল নির্মাণে ঢালাই মিস্ত্রি ও কুলি রেজার কাজ করেন।
এঁরা সব কী করলেন? বেশির ভাগ কিছুই করতে না পেরে আধপেটা খেয়ে লঙ্গরে সপরিবারে পাত পেতে আচ্ছে দিনের অপেক্ষায় রইলেন। কেন্দ্রীয় সরকার কয়েক মাস চাল/গম/ডাল দেয়ার চেষ্টা করল। কিন্তু তা’ দরকারের তুলনায় অপ্রতুল।কিন্তু নুন-তেল-আলু এবং রান্না করার কেরোসিন না কিনলে শুকনো চালডাল চিবিয়ে পেট ভরা যায় কি? তারপর ওদের মধ্যে যারা পরিযায়ী তারা ধার করে জমানো টাকা খরচ করে সাইকেলে চেপে এবং পায়ে হেঁটে নিজেদের গ্রামে ফিরে গেল। কিছু দুর্ঘটনায় এবং কিছু অসুস্থ হয়ে মারা পড়ল।যারা পৌঁছে গেল তারা দেখল গাঁয়ে কাজ নেই। গ্রাম স্বরোজগার যোজনার বা ক্ষেতে জন খাটার কাজ যত, কাজের লোক তার ছেয়ে বেশি। সেই কাজও দু’মাসে শেষ। লকডাউন উঠে গেলে তারা পুরনো কাজের জায়গায় ফিরে গেল। কিন্তু লকডাউনের ধাক্কা সামলে ব্যবসাপাতি, কারখানায় উৎপাদন আর আগের ছন্দে ফিরল না। বকায়া মাইনে পাওয়ার প্রতিশ্রুতি স্বপ্ন হয়ে রইল। কেউ কথা রাখেনি।এভাবে মানবমূল্যের যে লোকসান হোল তার সোশ্যাল অডিট কি কখনও হবে?
তাহলে লাভ কাদের হল?লাভ হোল বড় করপোরেট হাউসের। লাভ হোল আইটি সল্যুশন কোম্পানির এবং ওই ধরণের অনেকের যাদের স্টাফ ‘ওয়ার্ক ফ্রম হোম’ বলে ঘরে বসে সপ্তাহে প্রায় সাতদিনই কাজ করছে। যাদের অফিস ভাড়ার এবং বিজলি, ক্যান্টিন, মেইন্টেনান্স স্টাফের খরচা বেঁচে যাচ্ছে। এবং লকডাউনের বাহানায় হোয়াইট কলার স্টাফদেরও ২৫ বা ৩০% স্যালারি কাট মেনে নিতে রাজি করা যাচ্ছে।
লাভ সরকারি কর্মচারিদের। তাঁরা লকডাউন পিরিয়ডে আংশিক হাজিরা দিলেও পুরো মাইনে পাবেন। প্রাইভেট স্কুল কলেজের শিক্ষকদের লোকসান। তাঁরা পুরো মাইনে পাবেন না। লকডাউনে টিউশনও সম্ভব নয়।
সমাধান-গোটা দুনিয়ার অভিজ্ঞতা বলছে লকডাউন কোভিড সংক্রমণ আটকানোর জন্যে কোন স্থায়ী সমাধান নয়। আর্থিক চক্র থামিয়ে দিয়ে মুড়িমিছরির মত পাইকারি হারে সব দোকানে তালা ঝোলালে মুশকিল। যেসন কাজ বা পরিষেবায় ওয়ার্ক ফ্রম হোম সম্ভব নয়, সেগুলো আংশিক ভাবে হলেও খোলা রাখতে হবে।
এবারে ভাবা যাক আমাদের মানবসম্পদের কথা।দেখতে হবে যাতে এঁরা আবার গ্রামে ফিরে না যান। তাই দেখতে হবে লকডাউন যাতে একটানা না হয়। লকডাউনের সময় ‘দুয়ারে রেশন’ প্রজেক্টে গতি আনা যাক।আর ডায়রেক্ট ট্রান্সফার সিস্টেমে কাজ হারানো লোকের জন্যে নগদ ভাতার ব্যবস্থা করা সরকারের আশু কর্তব্য। দুই নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন ও অভিজিত বিনায়ক ব্যানার্জি এবং ওয়ার্ল্ড ব্যাংকের প্রাক্তন মুখ্য অর্থনীতিবিদ কৌশিক বসু ও রিজার্ভ ব্যাংকের প্রাক্তন গভর্নর রঘুরাম রাজন এ নিয়ে অনেকবার মন্তব্য করেছেন। প্রশ্ন উঠছে টাকা কোথায়?
ওঁদের পরামর্শ সরকার দরকার হলে নোট ছাপিয়ে নিক। মুদ্রাস্ফীতি পরে সামলে নেয়া যাবে, এখন দেশের গরীব-গুর্বো খেয়ে বাঁচুক।
গোটা বিশ্বে সবাই এই পথ নিয়েছে—আমেরিকা, বৃটেন, জার্মানি, জাপান সবাই। ভারত কেন শুধুমুদু উলটো পথে হাঁটবে?
লকডাউনের ফলে সংকটগ্রস্ত আদিম জীবিকা-লকডাউন ও সোশ্যাল ডিস্ট্যান্সের ভয়ে কোলকাতার সোনাগাছি এবং অন্যান্য লালবাতি এলাকাতে গতবছর থেকেই যৌনকর্মীরা কাজ হারিয়েছেন। যৌনকর্মীদের ইউনিয়ন ‘দুর্বার’ এবং কিছু এনজিও’র সহায়তায় এঁদের কোনরকমে দু’বেলা মোটা ভাতের জোগাড় হচ্ছে বটে, কিন্তু কতদিন? এবারের দ্বিতীয় ওয়েভের সংক্রমণ অনেক দ্রুত ছড়াচ্ছে এবং এর মারণ ক্ষমতা আগের ছেয়ে বেশি। গত সপ্তাহে চলে গেলেন দুর্বার সংস্থার প্রতিষ্ঠাতা ডঃ স্মরজিৎ জানা, কোভিডের আক্রমণে। এবার এঁরা বোধহয় সত্যি অনাথ হলেন।
বহু দিন পরে আমরা ‘জগৎসভায় শ্রেষ্ঠ আসন’ পেয়েছি। দৈনিক করোনা আক্রান্তের ডেটা কয়েক সপ্তাহ আগে ৪ লাখ পেরিয়ে গেছল, এখন প্রায় একলাখ কমলেও চার্টের শীর্ষে আমরাই আছি। মৃত্যু সংখ্যা ২.৫ লাখ ছাড়িয়েছে।
লোকে বিশ্বাস করল, শাঁখ ফুঁকে থালা বাজিয়ে নিষ্প্রদীপ করে ধর্মযুদ্ধ শুরু হল, ২১ দিন নব্বই দিনে গড়াল, কিন্তু আজও করোনা হারেনি।মনে হচ্ছে এ লড়াই চলছে, চলবে। অতএব ভাবা দরকার্ করোনা মহামারীর সংক্রমণ ঠেকাতে লকডাউন কোন স্থায়ী বা লাভজনক পদক্ষেপ কিনা। লকডাউন কার জন্যে?
প্রশ্ন ওঠে -লকডাউন কার জন্যে? কেন, সবার জন্যে। সবার প্রাণ বাঁচবে। তাই কি? বায়ুবাহিত সংক্রমণের হাত থেকে বাঁচতে ঘরের মধ্যে বন্ধ থাকার নিদান। কিন্তু যার ঘর নেই? আমি ফুটপাথবাসীদের কথা বলছিনা।আমি বলছি তাদের কথা যারা ভাড়ার বাড়িতে মাথা গুঁজে থাকে।এবং যারা ভিনরাজ্যে থেকে বা গ্রাম থেকে রুটি রুজির খোঁজে মহানগরে বা জেলা সদরে এসেছে। বলছি এ জন্যে যে ভারতের শ্রমশক্তির ৯০% হোল ইনফর্মাল লেবার বা অনিয়মিত শ্রমিক।
তারা কোথায় যাবে? যাবে কেন? যেখানে ছিল সেখানেই দাঁতে দাঁত চেপে পনেরটা দিন কাটিয়ে দেবে। পনেরটা দিন? কোন গ্যারান্টি আছে?গতবছরের অভিজ্ঞতার জমাখরচ সবার আগে বলা দরকার যে লকডাউন হলেও হাসপাতালের ডাক্তার, নার্স, ওয়ার্ডবয়, কেমিস্ট এবং অ্যাম্বুল্যান্স চালকদের প্রাণ হাতে করেও ঘর থেকে বেরোতে হবে। এর পর পুলিশ ও ব্যাংক কর্মচারিদের নম্বর। কিন্তু অন্যেরা? গত মার্চের লকডাউনে কাজ হারিয়েছে বিভিন্ন মতে প্রায় ৫০ থেকে ১২০ মিলিয়ন লোক। এদের উপর নির্ভরশীল পরিবার দ্রুত গরীবি রেখার নীচে নেমে যাচ্ছে। এরা জিরো-ইনকাম গ্রুপ থেকে কবে লোয়ার ইনকাম গ্রুপে ফিরবে আন্দাজ করা কঠিন।
আমরা সবাই জানি যে গতবারের লকডাউনের ফলে মার খেয়েছে গোটা অর্থব্যবস্থা, জিডিপি আগের বারের (+)৪% থেকে (-)৭% এ নেমে এসেছে। আনএমপ্লয়মেন্ট বা বেকারত্বের হার মার্চ’ ২০২০এর ৬.৫% থেকে বেড়ে সাময়িক ভাবে ২৩% ছাড়িয়ে গেছল। মার খেল ছোট ছোট দোকান, ছোট কারখানা, পরিষেবার ছোট প্রতিষ্ঠানগুলো।লকডাউন শুরু হওয়ার পর সবচেয়ে মার খেয়েছে খেলাধূলো, বিনোদন শিল্প এবং ট্যুরিজম ও হসপিটালিটি ব্যবসায়।
এদের সঙ্গে যুক্ত যে শ্রমিকেরা তাদের বেশিরভাগ অনিয়মিত রোজগারের, যেমন পিস রেটে বা দৈনিক মজুরিতে অলিখিত মৌখিক চুক্তির ভিত্তিতে কাজ করেন। তাঁরা অনেকেই মাইনে পান সপ্তাহান্তে বা মাসের শেষে। লকডাউনের ফলে উৎপাদিত পণ্যের ক্রেতা এবং পরিষেবার গ্রাহক ঘর থেকে না বেরোলে মালিকের আমদানি কমল। ফলে তাদের সোজা সমাধান হোল এই অনিয়মিত শ্রমিকদের আংশিক পারিশ্রমিক দেওয়া বা কিছুই না দেওয়া, খালি আশ্বাসন দেয়া যে সব কিছু আগেরমত হয়ে গেলে তাদের আবার কাজে ফিরিয়ে নেওয়া হবে এবং তখন বকায়া মজুরি চুকিয়ে দেওয়া হবে।
কিন্তু ততদিন? বাড়িওলা বকেয়া ভাড়া না দিলে ঘর খালি করতে বলছে। আর খাওয়ার জোগাড়? এরপর যাদের বৌ-বাচ্চা আছে তাদের তো গোদের উপর বিষফোঁড়া। এই মানুষেরা কারা? কী তাদের জীবিকা? এঁরা হলেন রাজমিস্ত্রি, ইলেক্ট্রিক মিস্ত্রি, প্লাম্বার, এসি এবং টিভি সারাইয়ের মিস্ত্রি, চুলকাটার নাপিত, স্থানীয় দুধওলা, মাছওলা, সব্জিওলা। এঁরা রিকশা টানেন, টোটো এবং অটো চালান; এঁরা কাজের মাসি। এঁরা বিউটি পার্লারে কাজ করেন, এঁরা ছোটখাটো জিনিস বিক্রি করেন, দোকানে সেলস ও ফাইফরমাশ খাটার কাজ করেন। এঁরা বড় শহরে বহুতল নির্মাণে ঢালাই মিস্ত্রি ও কুলি রেজার কাজ করেন।
এঁরা সব কী করলেন? বেশির ভাগ কিছুই করতে না পেরে আধপেটা খেয়ে লঙ্গরে সপরিবারে পাত পেতে আচ্ছে দিনের অপেক্ষায় রইলেন। কেন্দ্রীয় সরকার কয়েক মাস চাল/গম/ডাল দেয়ার চেষ্টা করল। কিন্তু তা’ দরকারের তুলনায় অপ্রতুল।কিন্তু নুন-তেল-আলু এবং রান্না করার কেরোসিন না কিনলে শুকনো চালডাল চিবিয়ে পেট ভরা যায় কি? তারপর ওদের মধ্যে যারা পরিযায়ী তারা ধার করে জমানো টাকা খরচ করে সাইকেলে চেপে এবং পায়ে হেঁটে নিজেদের গ্রামে ফিরে গেল। কিছু দুর্ঘটনায় এবং কিছু অসুস্থ হয়ে মারা পড়ল।যারা পৌঁছে গেল তারা দেখল গাঁয়ে কাজ নেই। গ্রাম স্বরোজগার যোজনার বা ক্ষেতে জন খাটার কাজ যত, কাজের লোক তার ছেয়ে বেশি। সেই কাজও দু’মাসে শেষ। লকডাউন উঠে গেলে তারা পুরনো কাজের জায়গায় ফিরে গেল। কিন্তু লকডাউনের ধাক্কা সামলে ব্যবসাপাতি, কারখানায় উৎপাদন আর আগের ছন্দে ফিরল না। বকায়া মাইনে পাওয়ার প্রতিশ্রুতি স্বপ্ন হয়ে রইল। কেউ কথা রাখেনি।এভাবে মানবমূল্যের যে লোকসান হোল তার সোশ্যাল অডিট কি কখনও হবে?
তাহলে লাভ কাদের হল?লাভ হোল বড় করপোরেট হাউসের। লাভ হোল আইটি সল্যুশন কোম্পানির এবং ওই ধরণের অনেকের যাদের স্টাফ ‘ওয়ার্ক ফ্রম হোম’ বলে ঘরে বসে সপ্তাহে প্রায় সাতদিনই কাজ করছে। যাদের অফিস ভাড়ার এবং বিজলি, ক্যান্টিন, মেইন্টেনান্স স্টাফের খরচা বেঁচে যাচ্ছে। এবং লকডাউনের বাহানায় হোয়াইট কলার স্টাফদেরও ২৫ বা ৩০% স্যালারি কাট মেনে নিতে রাজি করা যাচ্ছে।
লাভ সরকারি কর্মচারিদের। তাঁরা লকডাউন পিরিয়ডে আংশিক হাজিরা দিলেও পুরো মাইনে পাবেন। প্রাইভেট স্কুল কলেজের শিক্ষকদের লোকসান। তাঁরা পুরো মাইনে পাবেন না। লকডাউনে টিউশনও সম্ভব নয়।
সমাধান-গোটা দুনিয়ার অভিজ্ঞতা বলছে লকডাউন কোভিড সংক্রমণ আটকানোর জন্যে কোন স্থায়ী সমাধান নয়। আর্থিক চক্র থামিয়ে দিয়ে মুড়িমিছরির মত পাইকারি হারে সব দোকানে তালা ঝোলালে মুশকিল। যেসন কাজ বা পরিষেবায় ওয়ার্ক ফ্রম হোম সম্ভব নয়, সেগুলো আংশিক ভাবে হলেও খোলা রাখতে হবে।
এবারে ভাবা যাক আমাদের মানবসম্পদের কথা।দেখতে হবে যাতে এঁরা আবার গ্রামে ফিরে না যান। তাই দেখতে হবে লকডাউন যাতে একটানা না হয়। লকডাউনের সময় ‘দুয়ারে রেশন’ প্রজেক্টে গতি আনা যাক।আর ডায়রেক্ট ট্রান্সফার সিস্টেমে কাজ হারানো লোকের জন্যে নগদ ভাতার ব্যবস্থা করা সরকারের আশু কর্তব্য। দুই নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন ও অভিজিত বিনায়ক ব্যানার্জি এবং ওয়ার্ল্ড ব্যাংকের প্রাক্তন মুখ্য অর্থনীতিবিদ কৌশিক বসু ও রিজার্ভ ব্যাংকের প্রাক্তন গভর্নর রঘুরাম রাজন এ নিয়ে অনেকবার মন্তব্য করেছেন। প্রশ্ন উঠছে টাকা কোথায়?
ওঁদের পরামর্শ সরকার দরকার হলে নোট ছাপিয়ে নিক। মুদ্রাস্ফীতি পরে সামলে নেয়া যাবে, এখন দেশের গরীব-গুর্বো খেয়ে বাঁচুক।
গোটা বিশ্বে সবাই এই পথ নিয়েছে—আমেরিকা, বৃটেন, জার্মানি, জাপান সবাই। ভারত কেন শুধুমুদু উলটো পথে হাঁটবে?
লকডাউনের ফলে সংকটগ্রস্ত আদিম জীবিকা-লকডাউন ও সোশ্যাল ডিস্ট্যান্সের ভয়ে কোলকাতার সোনাগাছি এবং অন্যান্য লালবাতি এলাকাতে গতবছর থেকেই যৌনকর্মীরা কাজ হারিয়েছেন। যৌনকর্মীদের ইউনিয়ন ‘দুর্বার’ এবং কিছু এনজিও’র সহায়তায় এঁদের কোনরকমে দু’বেলা মোটা ভাতের জোগাড় হচ্ছে বটে, কিন্তু কতদিন? এবারের দ্বিতীয় ওয়েভের সংক্রমণ অনেক দ্রুত ছড়াচ্ছে এবং এর মারণ ক্ষমতা আগের ছেয়ে বেশি। গত সপ্তাহে চলে গেলেন দুর্বার সংস্থার প্রতিষ্ঠাতা ডঃ স্মরজিৎ জানা, কোভিডের আক্রমণে। এবার এঁরা বোধহয় সত্যি অনাথ হলেন।