অ্যাপশহর

মানসিক আঘাত দেওয়ার জন্য মায়ের চরিত্র নিয়েও প্রশ্ন তোলা বয়েছিল, তবে লড়াইটা তিনি ছাড়েননি

প্রথমেই একটা কথা বলে নিই৷ আদালত কিন্ত্ত কোনও নির্দেশ আমাদের পাঠায়নি৷

EiSamay.Com 28 Feb 2017, 12:25 pm
হায়দ্রাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ের আত্মঘাতী ছাত্র রোহিত ভেমুলার দলিত পরিচিতি গত জুনেই সমর্থন করেন গুন্টুরের কালেক্টর৷ ছ’মাস পর তাঁর বয়ান হঠাত্ বদলে গেল কেন ? প্রশ্ন তুললেন রোহিতের ভাই রাজা ভেমুলা ৷ আলাপে ঋতপ্রভ বন্দ্যোপাধ্যায়
EiSamay.Com an interview with raja vhemula
মানসিক আঘাত দেওয়ার জন্য মায়ের চরিত্র নিয়েও প্রশ্ন তোলা বয়েছিল, তবে লড়াইটা তিনি ছাড়েননি



ঋতপ্রভ বন্দ্যোপাধ্যায় : সদ্য রোহিত ভেমুলার মৃত্যুবার্ষিকী অতিক্রান্ত হল৷ বছর ঘুরতে না ঘুরতেই এক নতুন চ্যালেঞ্জ উপস্থিত আপনাদের সামনে৷ গত ১৪ ফেব্রুয়ারি আপনারা যে নোটিস পেয়েছেন , তাতে পনেরো দিন সময় দেওয়া হয়েছে , তার মধ্যে প্রমাণ করতে হবে , আপনারা সত্যিই দলিত৷ কী বলবেন ?


রাজা ভেমুলা : প্রথমেই একটা কথা বলে নিই৷ আদালত কিন্ত্ত কোনও নির্দেশ আমাদের পাঠায়নি৷ গুন্টুরের কালেক্টর শো -কজ নোটিস পাঠিয়েছে৷ জেলাস্তরের একটি স্ক্রুটিনি কমিটির রিপোর্টের প্রেক্ষিতে এই নোটিস৷ কিন্ত্ত আদালতের তরফে এই নোটিস নয়৷ এটা ঠিক যে, আমাদের ১৫ দিন সময় দেওয়া হয়েছে৷ তার মধ্যে প্রমাণ দাখিল করতে হবে , আমরা সত্যিই দলিত৷ তা না হলে আমাদের তফসিলভুক্ত সম্প্রদায়ের সার্টিফিকেটটি বাতিল হয়ে যাবে৷ ওই রিপোর্টে আরও উল্লেখ , আমরা ‘ভাদ্দেরা ’ জনজাতিভুক্ত৷ যা একেবারেই সঠিক নয়৷ সত্যি বলতে , আমরা এমন একটা কিছুই আশা করছিলাম৷ তাই ওই রিপোর্টটিও আমাদের কাছে নতুন নয়৷ আমরা বিচারব্যবস্থার দ্বারস্থ হয়েছি৷ আইনজ্ঞের পরামর্শ নিচ্ছি৷ আইনি পথেই এই নোটিসকে চ্যালেঞ্জ করব৷ আমাদের আইনজীবী যা বলবেন তা -ই করব৷ প্রথমবার আপনার ফোন যখন এল , তখন আমি ফোনটা কেটে দিই৷ আইনজীবীর সঙ্গে সে সময় কথা বলছিলাম৷ আপাতত ঠিক হয়েছে , আমরা এই নোটিসের উত্তর দেব৷ এবং তা আইনের পথেই৷ আমি হায়দরাবাদে গিয়ে সেখানকার আইনজীবীর পরামর্শও নেব৷ ২৬ ফেব্রুয়ারি আমরা গুন্টুর কালেক্টরের দফতরে লিখিত আবেদন করেছি , উত্তর দেওয়ার সময়সীমা আরও এক মাস বাড়ানোর জন্য৷ সেই চিঠির অবশ্য উত্তর এখনও আসেনি৷



কিন্ত্ত , কিছু দিন আগে ওই কালেক্টরই তো বলেছিলেন , রোহিত দলিত৷ হঠাত্ সেই বয়ান বদল হল কেন ?


এটা বিজেপির চক্রান্ত৷ শুধু চক্রান্তই নয় , কেন্দ্রীয় স্তর থেকে কলকাঠি নাড়ানো হচ্ছে বলে আমার ধারণা৷ না হলে কখনও জেলাপ্রশাসনের বক্তব্য এ ভাবে বদলে যেতে পারে ? আসল কথা , বিজেপি এই মামলায় তাদের নেতা -নেত্রীকে বাঁচাতে চাইছে৷ গত জুন মাসে ওই কালেক্টরই বলেছিলেন , আমাদের দলিত আত্মপরিচিতি নিয়ে কোনও সংশয় নেই৷ হঠাত্ ছ-সাত মাসে এই ভাবে ভোলবদল৷ এটা তো কোনও কারণ ছাড়া হয়নি৷ উপর থেকে চাপ এসেছে নিশ্চয়ই৷ ওরা যদি কোনও ভাবে এটা প্রমাণ করতে পারে যে রোহিত দলিত ছিল না , তা হলে রোহিতের উপর হওয়া নির্যাতনের যে অভিযোগ উঠেছে , সেটাও ভ্রান্ত হয়ে যাবে৷ এতে লাভ হবে বিজেপির৷ কারণ , যদি সত্যিটা সামনে আসে , তা হলে বিজেপি নেতাদের অনেকেই চাপে পড়তে পারেন৷ বন্দারু দত্তাত্রেয় , স্মৃতি ইরানি এবং হায়দরাবাদ কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য আপ্পা রাও ---সবাই এর সঙ্গে জড়িত৷ এদের বাঁচাতেই বিজেপির এ রকম মরিয়া চেষ্টা৷ এবং ছ’মাসের মধ্যে কালেক্টরের বয়ান বদল৷ এটা কি শুধু শুধু হল ? আমরা কি কিছুই বুঝতে পারছি না ? এক দিন সত্য প্রকাশ পাবে৷ আমরা আইনের পথেই লড়ব৷ আমার বিশ্বাস , অভিযুক্তরা শাস্তি পাবে৷



সমস্যাটা ঠিক কোথায় ? কেন আপনাদের দলিত পরিচয়টি নিয়ে প্রশ্ন উঠছে ?


দেখুন , আমার বাবা ছিলেন ‘অন্যান্য পিছিয়ে পড়া সম্প্রদায়ভুক্ত’ (ওবিসি )৷ কিন্ত্ত অনেক আগে থেকেই বাবা -মায়ের সম্পর্ক ছিল না৷ শেষে ২০০৬ সালে আইনসিদ্ধ ডিভোর্স হয়৷ তার নথিও আমাদের কাছে রয়েছে৷ কিন্ত্ত , ২০০৬ এর অনেক আগে থেকেই আমার মা বাবার সঙ্গে থাকতেন না৷ একা থাকতেন , আমাদের নিয়ে৷ মা সুতরাং , একাই আমাদের মানুষ করেছেন৷ মা ‘মালা ’ সম্প্রদায়ের৷ যা কিনা , তফসিলভুক্ত সম্প্রদায়ের অন্তর্গত৷ যেহেতু আমাদের বেড়ে ওঠার সময় বাবার কোনও ভূমিকা ছিল না এবং একা মা আমাদের বড়ো করে তুলেছেন , তাই আমরা মায়ের পরিচয়টাই স্বীকার করি৷ আমাদের আইনসিদ্ধ শংসাপত্র রয়েছে৷ এখন এটা নিয়েই প্রশ্ন তোলা হল৷ ওদের বক্তব্য , বাবা ‘ওবিসি ’ হলে ছেলেরাও ‘ওবিসি ’ হবে৷ আমরা ফ্রডুলেন্টলি ওই সার্টিফিকেট জোগাড় করেছি৷ আমরা এটাকে চ্যালেঞ্জ হিসেবেই দেখছি৷ যা করার আইনের পথে করব৷ আমি জোরের সঙ্গেই বলছি , আমরা দলিত৷ আমাদের সার্টিফিকেট বৈধ৷


আপনার মা রাধিকাদেবী সম্প্রতি বলেছেন , এই তদন্ত কমিটির প্রশ্নের মুখে পড়ে তিনি নাকি অসুস্থ বোধ করেছিলেন৷ কেন ?


আপনি যদি তেলুগু বুঝতে পারতেন , তা হলে বলতাম ওরা ঠিক কী ভাষায় আমার মাকে কী কী প্রশ্ন করেছে৷ মা -র কাছে খোলাখুলি জানতে চাওয়া হয় , আমার বাবার সঙ্গে যখন দীর্ঘ দিন সম্পর্ক ছিল না , তখন আমার মা আমাদের মানুষ করার জন্য অর্থ কোথা থেকে পেতেন৷ কী ভাবে ছেলেদের মানুষ করলেন ? বুঝতে পারছেন , ইঙ্গিত ছিল অত্যন্ত কুত্সিত৷ সরাসরি তাঁর চরিত্র নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়েছে৷ মা কিন্ত্ত একেবারে একা আমাদের মানুষ করেছে এবং অত্যন্ত কষ্ট করে৷ এই প্রশ্ন যখন মাকে করা হয় , আমরা তখনই এর বিরোধিতা করেছি৷ কিন্ত্ত , রোহিতের মৃত্যুবার্ষিকী যত এগিয়ে আসছিল , এমনিতেই মায়ের কষ্ট হচ্ছিল৷ সেটা আমরা বুঝতে পারছিলাম৷ তার উপর এই রকম নির্লজ্জ প্রশ্ন৷

আসলে মাকে এই ধরনের প্রশ্ন খুব কৌশলে করা হয়েছে৷ যাতে আমরা মানসিক ভাবে ভেঙে পড়ি এবং লড়াই ছেড়ে দিই , এ জন্যই মাকে ওই ভাবে আঘাত দেওয়া হয়েছে৷ বারবার এই ধরনের প্রশ্ন শুনলে বিপন্ন লাগে মারও৷ এর পর থেকে মা মানসিকভাবেও ধ্বস্ত৷ বাইরের কারও সঙ্গে কথা বলছেন না৷ আসলে মা তার ছেলেকে হারিয়ে প্রচলিত রীতিনীতি নিয়েই প্রশ্ন করেছে , সরাসরি বিজেপির দিকে আঙুল তুলেছে , তাই এই ধরনের কথা তাকে শুনতে হয়েছে৷ তবে , এটুকু বলতে পারি ওই মায়ের ছেলে হিসেবে আমি গর্বিত৷


রোহিতের মৃত্যুর পর বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিসরে কোনও বদল চোখে পড়েছে এই এক বছরে ?


সারা দেশজুড়ে ছাত্রছাত্রীদের মনোভাবে বেশ খানিকটা বদল এসেছে৷ এটুকুই৷ কিন্ত্ত , বিশ্ববিদ্যালয়ে কোনও বদল দেখতে পাইনি৷ যেমন ধরুন , রোহিতদের উপাচার্য আপ্পা রাওকে তো ওই ঘটনার পর দু’মাসের ছুটিতে পাঠানো হয়৷ উনি এসে দিব্যি কাজে যোগ দিয়েছেন৷ ওখানে তো একনায়কতন্ত্র চলছে৷ নিজেদের ক্ষমতা কাজে লাগিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিসরে রাজনীতির আখড়া গড়ে তোলা হচ্ছে৷ সেই ক্ষমতা প্রয়োগ করেই বিশ্ববিদ্যালয় নিপীড়নের জায়গায় পরিণত হয়েছে৷ যেখানে তুমি ভিন্ন মতের কথা বলেছ কি কর্তৃপক্ষের রোষের মুখে পড়বে৷ জেএনইউ -এ দেখুন৷ এবিভিপির বিরুদ্ধে মুখ খোলার পর , লড়ার পর থেকে নাজিব আহমেদকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না৷ গত চার পাঁচ মাস থেকে তার খোঁজ নেই৷ একটা ছেলে স্রেফ নেই৷ তার কোনও হদিস নেই৷ কেউ কিছু জানে না৷ কেউ কিছু দেখেনি৷ আজ সকালে ছিল সে , রাত থেকে খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না …৷ অদ্ভুত লাগে না ? আমার তো মনে হয় , রোহিতের মৃত্যুর মতোই ওই ঘটনা৷ রোহিতের ঘটনার সঙ্গে প্রত্যক্ষ যোগ আছে৷ রোহিতের ক্ষেত্রে বিষয়টা সামনে এসেছে৷ লোকে কথা বলেছে৷ নাজিবের ক্ষেত্রে ততটা আলোচনা হচ্ছে না৷ ছাত্রছাত্রীরা লড়ছে৷ কিন্ত্ত এটা পুরোপুরি রাজনৈতিক ব্যাপার বলে মনে হয় আমার৷ যারা ক্ষমতাশীল গোষ্ঠীর পক্ষ নেবে না , তাদের সঙ্গেই এই জিনিসটা হবে৷ আমি রোহিতের সঙ্গে নাজিবের ‘হারিয়ে যাওয়াটা ’কে মিলিয়ে দেখতে পারি৷ ওর পরিবারের মনের অবস্থাও আঁচ করতে পারি৷ আমার বিশ্বাস এক দিন সত্য সামনে আসবে৷


রোহিতের মৃত্যুর পর আপনারা বিচার চেয়ে লড়ে যাচ্ছেন৷ কী রকম প্রতিকূল পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হচ্ছে ?


অনেকবার প্রতিকূল পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছি৷ বলতে গেলে প্রতিদিনই হতে হয়৷ এই তো যে নোটিসের প্রসঙ্গে আপনার সঙ্গে কথা হচ্ছে , সেই রিপোর্টটিই তো যথেষ্ট আমাদের লড়াইকে নিষ্প্রভ করে দেওয়ার জন্য৷ মা -র উপর তো বটেই এখন আমার উপরও নানা মহল থেকে চাপ দেওয়া হয়৷ কখনও হুমকি ফোন আসে৷ ‘থ্রেট কল ’ যাকে বলে৷ মা -ও এমন ফোন পেয়েছে৷ শুধু এ রকম চাপ নয় , নানা প্রলোভনও দেখানো হয় সেই সঙ্গে৷ চাকরি -বাকরি নিয়ে৷ আমি পুদুচেরি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমএসসি করি অ্যাপলায়েড জিওলজিতে৷ আরও পড়াশোনার ইচ্ছে আছে৷ বিজ্ঞানী হওয়ার স্বপ্ন দেখতাম৷ কিন্ত্ত রোহিত চলে যাওয়ার পর আমাকে মায়ের পাশে দাঁড়াতে হয়েছে৷ আমাকে দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়াল চাকরির একটা সুযোগ দিয়েছিলেন৷ আমি কিন্ত্ত সেই চাকরি নিতে অস্বীকার করিনি৷ কিন্ত্ত সেখানে বিজেপির তরফে মামলা করা হয়৷ ফলে সেটা এখন বিচারাধীন৷ এ নিয়ে আমি মন্তব্য করতে চাই না৷ বাড়তি খরচ চালানোর জন্য এখন মালবোঝাই অটো চালাতে হয় আমাকে৷ গুন্টুর থেকে টেনালির মধ্যে৷ এটা যেমন একটা দিক , তেমনই উল্টো ছবিও রয়েছে৷ আমরা অনেক মানুষের সাহায্য পাচ্ছি৷ দেশের বিভিন্ন কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র -ছাত্রী মাস্টারমশাই তো বটেই এমনকী সংবাদমাধ্যমের একটা বড়ো অংশ আমাদের লড়াইটাকে স্বীকৃতি জানাচ্ছে৷ প্রান্তি বলে এটার উল্লেখও করতে হবে৷ শেষ পর্যন্ত বলব , আমরা ন্যায়বিচার চাই৷ রোহিতের মৃত্যুর জন্য যারা দায়ী , তাদের শাস্তি চাই৷ আমরা আইনের পথে লড়াইটা চালিয়ে যাব৷

পরের খবর

Editorialসম্পর্কে আরও বিস্তারিত ও নতুন খবর জানতে ক্লিক করুন। সব ধরনের ব্রেকিং, আপডেট এবং বিশ্লেষণ সবার প্রথম বাংলায় পড়তে ক্লিক করুন Bengali Newsএই সময় ডিজিটাল