রজতাভ মৈত্র
কলকাতায় সবাই যখন সবে প্যান্ডেল পরিক্রমা শুরু করেছেন, আমাদের এখানে কিন্তু ততদিনে দুর্গাপুজো হয়ে গিয়েছে! আসলে অনাবাসী বাঙালিদের পুজো পঞ্জিকামাফিক নয়, নির্ভরশীল সপ্তাহান্তের ছুটির উপর। কী আর করা যায়, যস্মিন দেশে যদাচার! শুধু পুজোই বা কেন, দেশীয় যে কোনও অনুষ্ঠানে উইকএন্ড ছাড়া গতি নেই। আপস করতে হয় আরও অনেক রীতিনীতির সঙ্গে। চিরন্তন মাটির প্রতিমা আনা এবং সামলে রাখা বেশ কষ্টকর, ভেঙে যাওয়ার আশঙ্কা প্রবল। তাই বিকল্প হিসেবে ফাইবার গ্লাসের প্রতিমাই এখন চল। সুখের কথা, সাবেক কুমোরটুলিতেই তার জন্ম এবং দেখতে অবিকল মাটির প্রতিমার মতো। ওজনটা কম হওয়ার জন্য কলকাতা থেকে এত দূর জাহাজে করে নিয়ে আসাটা কিঞ্চিৎ ব্যয়সাপেক্ষ। বিসর্জনের জন্য নদী বা জলাশয় ব্যবহারের প্রশ্ন নেই, তাই ফি বছর পুজোশেষে সন্তান-সহ মা দুর্গাকে প্যাক করে পাঠিয়ে দেওয়া হয় স্টোরেজে। ২০১৪ সাল থেকে প্রতিমা আনানো হয়েছিল এবং এখনও তাই পুজো পাচ্ছে। সে প্রতিমা আনাও এক পর্ব! আমাদের তখনকার সভাপতি সহ-সভাপতি কলকাতা ভ্রমণের সময় কুমোরটুলিতে গিয়ে প্রতিমা পছন্দ করে বায়না দিয়ে এসেছিলেন। প্রতিমার নির্মাণ শেষ হলে নর্থ ক্যারোলিনা থেকে বকেয়া টাকা মেটানোটাও খুব একটা সহজ নয়। সে না হয় হল, এরপর জাহাজে চাপিয়ে ঠাকুর নিয়ে যাওয়া আর এক ঝকমারি। তখন মার্কিন সরকারের কুখ্যাত শাটডাউনের পালা চলছে, তাই কাস্টমসের দফতরে তালা। এদিকে দোরগোড়ায় পুজো কিন্তু নতুন প্রতিমার হদিস নেই! চিন্তায় কর্মকর্তাদের রাতের ঘুম কাবার। শেষে বেঙ্গলি কমিউনিটির এক পুরনো সদস্য এবং প্রাক্তন সভাপতির হস্তক্ষেপে ওয়াশিংটনে বহু কাঠখড় পুড়িয়ে ঠিক সময়ে প্রতিমা আনা গিয়েছিল।
গোড়ায় সংগঠনের নাম নর্থ ক্যারোলিনা বেঙ্গলি অ্যাসোসিয়েশন ছিল। ২০০৮ সালে খোলনলচে পালটে নাম হল বেঙ্গলি অ্যাসোসিয়েশন অফ নর্থ ক্যারোলিনা। শুরু হয়েছিল মুষ্টিমেয় কয়েকঘর বাঙালিকে নিয়ে। সেই সময় র্যালে এলাকায় বাঙালি তথা ভারতীয়ের সংখ্যা খুবই কম ছিল। যে যার বাড়ি থেকে রান্নাবান্না করে পুজোর ভোগ তৈরি হতো। নিজেরাই যেমন পারতেন মণ্ডপ সাজাতেন। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের জন্য ডাক পড়তো স্থানীয় বা সাগরপারের শিল্পীদের। এখনও সেই ঐতিহ্য বিরাজমান। কখনও বা কলকাতার মাঝারি মাপের শিল্পী জোগাড় করে এর ওর বাড়িতে রেখে অনুষ্ঠান করানোর চল ছিল। তবে আয়োজন যতই কম হোক, কখনও পুজোর আনন্দে ভাটা পড়েনি। সেই পুজোর আড়েবহরে এখন মহীরূহ, অংশগ্রহণ করেন প্রায় ৯০০ মানুষ। র্যালে চত্বরে এটাই সবচেয়ে বড় পুজো।
পুজো হয় যথারীতি উইকএন্ডেই, অর্থাৎ শুক্র থেকে রবি দিনরাত। বর্তমান পুজোমণ্ডপ স্থাপিত হয় র্যালের পাশের শহর চ্যাপেল হিলের ইস্ট চ্যাপেল হিল হাইস্কুলে। বেশ কয়েক বছর ওখানেই পুজো হচ্ছে। চাঁদা দেন সদস্য এবং বহিরাগত, সকলেই। এখন আর বাড়ি থেকে নয়, ভোগ আসে স্থানীয় রেস্তোরাঁ থেকেই। মিষ্টি আসে এক বাঙালি দোকান থেকে। প্রতি বছর যে হারে দর্শনার্থীর সংখ্যা বাড়ছে, তাতে প্রায়ই ভোগ পরিমাণে কুলোনো যাচ্ছে না। নতুন করে বরাত দিতে হচ্ছে রেস্তোরাঁয়। পরিবেশন অবশ্য নিজেরাই করা হয় কোমর বেঁধেস স্ত্রী-পুরুষ ছোট-বড় নির্বিশেষে। নিজেদের না জুটলেও সবাইকে ভোগ খাওয়ানোর আনন্দই আলাদা! পুজোর কাজে নবীন এমনকি দেশ থেকে বেড়াতে আসা আত্মীয়রাও শামিল হন। শুক্রবার সন্ধ্যা থেকে শুরু হয় মণ্ডপ ও প্রতিমা সাজানোর পালা। চালচিত্র তৈরিতে লেগে পড়েন তাবড় ইঞ্জিনিয়ার, বিজ্ঞানী ও প্রযুক্তিবিদরা। ভালো লাগে প্রেক্ষাগৃহের মার্কিন কর্মী ধোপদুরস্ত পাঞ্জাবি গায়ে চড়িয়ে পুজোমণ্ডপে হাজির হলেও। প্রতিবছরই আমন্ত্রিত শিল্পী ছাড়াও নাচ, শ্রুতি নাটক এবং বাংলা দীর্ঘ নাটকের আয়োজন করা হয় পুজো প্রাঙ্গণে। মাসখানেক আগেই শুরু হয় মহড়া। মহড়ার চোটে মাঝেমাঝে প্রাণ ত্রাহি ত্রাহি করে, হয়তো অনেকে ভাবেন, আর না! কিন্তু যখন ঝলমলে প্রেক্ষাগৃহে পাশের বাড়ির সফ্টওয়্যার প্রোগ্রামারের অসামান্য রবীন্দ্রসংগীত শ্রোতাদের বাহবা কুড়োয় অথবা নিজেদের ছেলেমেয়ের গান, নৃত্য বা ব্যান্ডের মতো পরিবেশন সবাইকে মুগ্ধ করে, তখন মনে হয় এর চেয়ে অনাবিল তৃপ্তি আর কোথায় মেলে! এখন পুজোয় কলকাতার বহু নামীদামি শিল্পীও মঞ্চ মাতিয়ে যান। তাঁদের অনেকের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ পরিচয়ও তৈরি হয়। কখনও দেশে ফেরার পথে বিমানে তাঁদেরই কারও সঙ্গে দেখা হয়ে গেলে জমে ওঠে দুরন্ত আড্ডা। আসলে পুজো মানেই যে এক মহামিলনমেলা!
কলকাতায় সবাই যখন সবে প্যান্ডেল পরিক্রমা শুরু করেছেন, আমাদের এখানে কিন্তু ততদিনে দুর্গাপুজো হয়ে গিয়েছে! আসলে অনাবাসী বাঙালিদের পুজো পঞ্জিকামাফিক নয়, নির্ভরশীল সপ্তাহান্তের ছুটির উপর। কী আর করা যায়, যস্মিন দেশে যদাচার! শুধু পুজোই বা কেন, দেশীয় যে কোনও অনুষ্ঠানে উইকএন্ড ছাড়া গতি নেই। আপস করতে হয় আরও অনেক রীতিনীতির সঙ্গে। চিরন্তন মাটির প্রতিমা আনা এবং সামলে রাখা বেশ কষ্টকর, ভেঙে যাওয়ার আশঙ্কা প্রবল। তাই বিকল্প হিসেবে ফাইবার গ্লাসের প্রতিমাই এখন চল। সুখের কথা, সাবেক কুমোরটুলিতেই তার জন্ম এবং দেখতে অবিকল মাটির প্রতিমার মতো। ওজনটা কম হওয়ার জন্য কলকাতা থেকে এত দূর জাহাজে করে নিয়ে আসাটা কিঞ্চিৎ ব্যয়সাপেক্ষ। বিসর্জনের জন্য নদী বা জলাশয় ব্যবহারের প্রশ্ন নেই, তাই ফি বছর পুজোশেষে সন্তান-সহ মা দুর্গাকে প্যাক করে পাঠিয়ে দেওয়া হয় স্টোরেজে।
গোড়ায় সংগঠনের নাম নর্থ ক্যারোলিনা বেঙ্গলি অ্যাসোসিয়েশন ছিল। ২০০৮ সালে খোলনলচে পালটে নাম হল বেঙ্গলি অ্যাসোসিয়েশন অফ নর্থ ক্যারোলিনা। শুরু হয়েছিল মুষ্টিমেয় কয়েকঘর বাঙালিকে নিয়ে। সেই সময় র্যালে এলাকায় বাঙালি তথা ভারতীয়ের সংখ্যা খুবই কম ছিল। যে যার বাড়ি থেকে রান্নাবান্না করে পুজোর ভোগ তৈরি হতো। নিজেরাই যেমন পারতেন মণ্ডপ সাজাতেন। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের জন্য ডাক পড়তো স্থানীয় বা সাগরপারের শিল্পীদের। এখনও সেই ঐতিহ্য বিরাজমান। কখনও বা কলকাতার মাঝারি মাপের শিল্পী জোগাড় করে এর ওর বাড়িতে রেখে অনুষ্ঠান করানোর চল ছিল। তবে আয়োজন যতই কম হোক, কখনও পুজোর আনন্দে ভাটা পড়েনি। সেই পুজোর আড়েবহরে এখন মহীরূহ, অংশগ্রহণ করেন প্রায় ৯০০ মানুষ। র্যালে চত্বরে এটাই সবচেয়ে বড় পুজো।
পুজো হয় যথারীতি উইকএন্ডেই, অর্থাৎ শুক্র থেকে রবি দিনরাত। বর্তমান পুজোমণ্ডপ স্থাপিত হয় র্যালের পাশের শহর চ্যাপেল হিলের ইস্ট চ্যাপেল হিল হাইস্কুলে। বেশ কয়েক বছর ওখানেই পুজো হচ্ছে। চাঁদা দেন সদস্য এবং বহিরাগত, সকলেই। এখন আর বাড়ি থেকে নয়, ভোগ আসে স্থানীয় রেস্তোরাঁ থেকেই। মিষ্টি আসে এক বাঙালি দোকান থেকে। প্রতি বছর যে হারে দর্শনার্থীর সংখ্যা বাড়ছে, তাতে প্রায়ই ভোগ পরিমাণে কুলোনো যাচ্ছে না। নতুন করে বরাত দিতে হচ্ছে রেস্তোরাঁয়। পরিবেশন অবশ্য নিজেরাই করা হয় কোমর বেঁধেস স্ত্রী-পুরুষ ছোট-বড় নির্বিশেষে। নিজেদের না জুটলেও সবাইকে ভোগ খাওয়ানোর আনন্দই আলাদা! পুজোর কাজে নবীন এমনকি দেশ থেকে বেড়াতে আসা আত্মীয়রাও শামিল হন। শুক্রবার সন্ধ্যা থেকে শুরু হয় মণ্ডপ ও প্রতিমা সাজানোর পালা। চালচিত্র তৈরিতে লেগে পড়েন তাবড় ইঞ্জিনিয়ার, বিজ্ঞানী ও প্রযুক্তিবিদরা। ভালো লাগে প্রেক্ষাগৃহের মার্কিন কর্মী ধোপদুরস্ত পাঞ্জাবি গায়ে চড়িয়ে পুজোমণ্ডপে হাজির হলেও। প্রতিবছরই আমন্ত্রিত শিল্পী ছাড়াও নাচ, শ্রুতি নাটক এবং বাংলা দীর্ঘ নাটকের আয়োজন করা হয় পুজো প্রাঙ্গণে। মাসখানেক আগেই শুরু হয় মহড়া। মহড়ার চোটে মাঝেমাঝে প্রাণ ত্রাহি ত্রাহি করে, হয়তো অনেকে ভাবেন, আর না! কিন্তু যখন ঝলমলে প্রেক্ষাগৃহে পাশের বাড়ির সফ্টওয়্যার প্রোগ্রামারের অসামান্য রবীন্দ্রসংগীত শ্রোতাদের বাহবা কুড়োয় অথবা নিজেদের ছেলেমেয়ের গান, নৃত্য বা ব্যান্ডের মতো পরিবেশন সবাইকে মুগ্ধ করে, তখন মনে হয় এর চেয়ে অনাবিল তৃপ্তি আর কোথায় মেলে! এখন পুজোয় কলকাতার বহু নামীদামি শিল্পীও মঞ্চ মাতিয়ে যান। তাঁদের অনেকের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ পরিচয়ও তৈরি হয়। কখনও দেশে ফেরার পথে বিমানে তাঁদেরই কারও সঙ্গে দেখা হয়ে গেলে জমে ওঠে দুরন্ত আড্ডা। আসলে পুজো মানেই যে এক মহামিলনমেলা!