অন্য দিকে, পশ্চিমবঙ্গের একটি ক্ষুদ্র অংশে গোর্খারা সংখ্যগরিষ্ঠ বলে তাকে মর্যাদা দিতে হবে, এমন দাবি অযৌক্তিক মনে হতেই পারে। কিন্তু সেটা যুক্তি দিয়ে বোঝানো দরকার। লিখছেন অরুনাভ ঘোষ।
বাঙালিদের চোখে দার্জিলিং, কালিম্পং, কার্শিয়াং-এর গোর্খারা খুব ভালো মানুষ৷ কারণ সমতলের মানুষদের পর্যটনের জন্য গোর্খাদের পাহাড়টা সত্যিই সুন্দর৷ পাহাড়ে বেড়াতে গিয়ে বাঙালিরা উপলব্ধি করেন , গোর্খাদের আতিথেয়তার কোনও তুলনা নেই৷ তাই বাঙালিরা চান, গোর্খাদের উন্নতি হোক , পাহাড়ের ভালো হোক৷ বাংলা থেকে দার্জিলিংকে গোর্খারা বিচ্ছিন্ন করতে চান, এ কথা বহু দশক ধরে জানা সত্ত্বেও বাঙালিরা গোর্খাদের ভালো চান-এমন একটা ধারণাও কিন্ত্ত বাঙালিদের মধ্যে রয়েছে৷ এই ধারণার বশবর্তী হয়ে বাঙালিরা নিজেদের বেশ মহত্ ও উদার মনে করেন এবং শ্লাঘা বোধ করেন৷ আসলে কিন্ত্ত এতটা শ্লাঘার অবকাশ নেই৷ পরিস্থিতিটা একটু তলিয়ে বোঝার চেষ্টা করলে রায়বাহাদুর থেকে রামা কৈবর্ত পর্যন্ত সকলেই বুঝতে পারবেন , পাহাড়ের প্রতি বা পাহাড়ের মানুষের প্রতি বাঙালির এই অনুভূতি কোনও সংহতির বোধ থেকে উত্সারিত নয়৷ এ আসলে খানিকটা করুণা -মিশ্রিত কল্যাণেচ্ছা৷ ব্রিটিশদের মধ্যেও বাঙালিদের প্রতি অনেকটা এই রকম অনুভূতিই ছিল৷
গোর্খারা কিন্ত্ত বাঙালির করুণার পাত্র নন, তাঁরা করুণা চান-ও না৷ গোর্খারা নিজেদের হকটা আদায় করে নিতে চান৷ আর বাঙালি বলে , নিজের ভালো পাগলেও বোঝে , শুধু গোর্খারাই বোঝেন না৷ প্রশ্ন হল , গোর্খাদের ভালো কীসে, সেটা বাঙালির চোখ দিয়ে দেখলে কী ভাবে বোঝা যাবে ? গোর্খার চোখ দিয়ে দেখার চেষ্টা করতে হবে পরিস্থিতিটাকে৷ না হলে কিছুতেই বোঝা যাবে না মাঝে-মধ্যেই কেন আগুন জ্বলে ওঠে দার্জিলিং , কালিম্পং , কার্শিয়াঙে৷
ব্রিটিশ আমলে আমাদের দেশের মানুষের সমস্যাকে ইংরেজরা তাঁদের নিজেদের চোখ দিয়ে দেখার চেষ্টা করতেন৷ দৃষ্টিভঙ্গিতে গলদ থেকে যেত সেখানেই৷ ভারতীয়দের উন্নতি হোক , অনেক ইংরেজই হয়তো তা চাইতেন৷ সে সময়ের শিক্ষিত ভারতীয়দের প্রতি, বিশেষত শিক্ষিত বাঙালির প্রতি ব্রিটিশদের একটা করুণা মিশ্রিত সহমর্মিতা ছিল৷ কারণ শিক্ষিত বাঙালি আপ্রাণ চেষ্টা করতেন ব্রিটিশদের অনুকরণ করার , সাহেবি আদব -কায়দা রন্ত করার৷ এ সব যত ভালো ভাবে রন্ত করা যাবে , ততই ব্রিটিশদের কাছে যাওয়া যাবে --- ধারণা ছিল আমাদের৷ বাঙালিদের এই আনুগত্য স্বাভাবিক ভাবেই ব্রিটিশদের ভালো লাগত৷ কিন্ত্ত সেই ভালো লাগা ব্রিটিশ শাসককে কখনওই রাজা -প্রজার মধ্যবর্তী ভেদরেখা মুছে দিতে অনুপ্রাণিত করেনি৷ ব্রিটিশরা কখনওই বাঙালিকে বা অনুগত ভারতীয়কে নিজেদের স্তরে তুলে নিয়ে গিয়ে প্রশাসন চালানোর কথা ভাবেননি৷ তাই ব্রিটিশ আমলে কলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতি আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের মেধা ইংরেজদের কাছে অত্যন্ত সমাদৃত হলেও , তাঁকে কখনও প্রধান বিচারপতি পদে বসতে দেওয়া হয়নি৷ একই ভাবে ব্রিটিশ ফেডারেল কোর্টেও কোনও বাঙালি বা ভারতীয় বিচারপতিকে খুঁজে পাওয়া যেত না৷ শীর্ষ প্রশাসনিক পদগুলিতেও বাঙালিরা এবং ভারতীয়রা ব্রাত্য ছিলেন৷
একই ভাবে স্বাধীনতার পরে কোনও গোর্খাকে কলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতি করার কথা কেউ ভাবেননি৷ পুলিশ -প্রশাসনের সর্বোচ্চ পদেও তাঁদের কখনও নিয়োগ করা হয়নি৷ ওঁরা আমাদের ‘ভাই ’, কিন্ত্ত রাজ্যের সর্বোচ্চ পদে ওঁদের পাঠানোর কথা আমরা ভাবতেই পারি না৷
সমাজতত্ত্ববিদ হোমি কে ভাবা তাঁর বই ‘লোকেশন অব কালচার ’-এ লিখেছেন , ‘যখনই আমরা অন্য কোনও ব্যক্তির বিচার করি , তখনই আমাদের নিজেদের বিশ্বাস এবং ধারণা আমাদের দৃষ্টি এবং বিচারবুদ্ধিকে মেঘাচ্ছন্ন করে দেয়৷ ব্যক্তি হিসেবে আমরা সব সময় নিজেদের পথটাকেই সঠিক পথ বলে মনে করি৷ আর যে বা যাঁরা অন্য ভাবে ভাবনা -চিন্তা করেন , তাঁদের সব সময়ই যুক্তিহীন ও বেঠিক বলে মনে করি এবং বিশ্বাস করি যে এঁদের জন্য আমাদের সময়ের অপব্যয় হওয়া উচিত নয়৷ এটা আরও বেশি সত্য হয়ে ওঠে তখন , যখন ভিন্নমতের ব্যক্তিটি জাতিগত ভাবে বা সামাজিক ভাবে বা অর্থনৈতিক ভাবে আমাদের চেয়ে পিছিয়ে থাকেন৷ আমরা সে ক্ষেত্রে পৃথিবী সম্পর্কে আমাদের নিজেদের ধারণার প্রেক্ষাপটে ফেলে তাঁদের বিচার করি , তাঁদের ভাবনা বা দৃষ্টিভঙ্গি একেবারেই বিচার করি না৷ ’ ভাবা নিজের বইতে ‘নকলনবীশ ’দের নিয়ে অনেক কথা লিখেছেন৷ লেখকের ভাষায় , ‘Mimic Men’৷ হোমি কে ভাবার ব্যাখ্যা --- ব্রিটিশরা ভারতে এক বিশেষ প্রজাতির মানুষ তৈরি করেছিলেন , যে প্রজাতি ছিল শাসক ব্রিটিশ এবং শাসিত ভারতীয়ের মধ্যে সংযোগ রক্ষা করার সেতু৷
ভাবা লিখেছেন , ‘এঁরা মূলত বাঙালি ছিলেন এবং সব রকম ভাবে ব্রিটিশদের নকল করতেন , ব্রিটিশ কাঠামোর মধ্যে উপরে ওঠার তাগিদে এঁরা ব্রিটিশদের জীবনযাত্রা ,জীবনধারা এবং চিন্তা -ভাবনার প্রক্রিয়াকেও নকল করতেন৷ কিন্ত্ত ব্রিটিশরা সর্বদাই এঁদেরকে নিজেদের চেয়ে হীন হিসেবে দেখতেন এবং কখনওই সম্পূর্ণ আপন করে নিতেন না৷ এক দিকে এঁদের বলা হত , ব্রিটিশদের সঙ্গে যত বেশি তাঁরা মিশে যেতে পারবেন , তাঁদের উন্নতির সম্ভাবনা ততই বাড়বে৷ অন্য দিকে যখনই পদোন্নতির বা উচ্চপদে আসীন হওয়ার সুযোগ আসত , তখন সেগুলো ব্রিটিশরাই পেতেন , তাঁদের অনুকরণকারীরা নন৷ ’গোর্খাদের প্রতি বাঙালির আচরণও কিন্ত্ত অনেকটা এই রকমই৷ গোর্খারা ততক্ষণই ভালো , যতক্ষণ তাঁরা বাঙালির অনুগত৷ বাংলার তথা বাঙালির সরকার এতই ‘উদার ’ যে, পাহাড়ের ছেলে -মেয়েরা স্কুলে নেপালি ভাষায় লেখাপড়া করার সুযোগ পাচ্ছে৷ শুধু চতুর্থ ভাষা হিসেবে তাদের বাংলা পড়তে বলা হচ্ছে৷ কিন্ত্ত সমতলের ছেলে -মেয়েদের কখনওই বলা হচ্ছে না , তৃতীয় বা চতুর্থ ভাষা হিসেবে নেপালিটা শিখতে হবে৷ সমতলের মানুষ পাহাড়ে বেড়াতে যাচ্ছেন , সরকারি উদ্যোগে পাহাড়ে পর্যটন পরিকাঠামো নাকি বাড়ছে , তাতে নাকি গোর্খাদের খুব উন্নতিও হচ্ছে৷ কিন্ত্ত একটু খোঁজ নিলেই জানা যাচ্ছে , পাহাড়ের হোটেল -রেস্তোরাঁ-লজ -গেস্ট হাউজগুলির প্রায় কোনওটিই আসলে গোর্খাদের নয়৷ নামে বা বেনামে সে সবের মালিকানা সমতলের মানুষের হাতে৷ এর পরেও গোর্খাদের মধ্যে ক্ষোভ থাকবে না ?ভাষার ভিত্তিতে রাজ্য গঠনের দাবি ভারতে নতুন নয়৷ বরং ভারত স্বাধীন হওয়ার পর থেকে যতগুলি রাজ্য ভাগ হয়েছে , সেগুলির অধিকাংশই ভাগ হয়েছে ভাষার ভিত্তিতে৷
বম্বে ভেঙে তৈরি হয়েছে মহারাষ্ট্র ও গুজরাত৷ পঞ্জাব ভেঙে তৈরি হয়েছে হরিয়ানা৷ অসমকে সাতটি রাজ্যে ভাগ করা হয়েছে৷ সুতরাং ভাষার ভিত্তিতে গোর্খাল্যান্ড রাজ্য গঠনের দাবি তোলা অযৌক্তিক কিছু নয়৷ মাত্র তিন -চারটি বিধানসভা কেন্দ্র নিয়ে একটা গোটা নতুন রাজ্য গঠন করা সম্ভব কিনা , সে অন্য প্রশ্ন৷ সুবিশাল রাজ্য পশ্চিমবঙ্গের খুব ছোটো একটি এলাকায় গোর্খারা সংখ্যাগরিষ্ঠ বলেই সেই অঞ্চলকে আলাদা রাজ্যের মর্যাদা দিয়ে দিতে হবে , এমন দাবিকে অযৌক্তিক মনে হতেই পারে৷ সে ক্ষেত্রে রাজ্য সরকারের উচিত , যুক্তি দিয়ে সে কথাই বুঝিয়ে বলা৷ কিন্ত্ত আন্দোলনকারীদের সঙ্গে আলোচনাতেই বসব না , এমন কথা সরকার বলতে পারে না৷ গোড়া থেকেই যেন মারমুখী মেজাজে সরকার , পরিস্থিতি আরও বেশি জটিল হয়েছে সেই কারণেই৷
আসলে সমতলের কিছু মানুষ পাহাড়িদের চিরকাল বশংবদ হিসেবে দেখতে অভ্যস্ত৷ আমাদের পছন্দ নয় এমন কোনও দাবি তুললেই পাহাড়িদের উপর খড়্গহস্ত হয়ে উঠি আমরা৷ সুবাস ঘিসিং পৃথক গোর্খাল্যান্ড চেয়ে সরব হতেই তদানীন্তন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুর পুলিশ প্রবল বিক্রমে ময়দানে নেমে পড়েছিল পাহাড় শাসন করতে৷ ব্যাপক পুলিশি অত্যাচারের মুখে ঘিসিং সমঝোতায় আসতে বাধ্য হন৷ তত্ক্ষণাত্ তাঁকে দার্জিলিং গোর্খা পার্বত্য পরিষদের (ডিজিএইচসি ) মাথায় বসিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা হয় এবং ডিজিএইচসি -র হাতে প্রচুর টাকা দিয়ে ঘিসিংকে পকেটে পুরে ফেলা হয়৷ পাহাড়ের উন্নয়নের নামে যে বিপুল পরিমাণ টাকা ঘিসিংদের দেওয়া হত , তার হিসেব কিন্ত্ত চাইত না রাজ্য সরকার৷
দীর্ঘ দিন ঘিসিং -রাজ চলার পর বিমল গুরুংয়ের উত্থান পাহাড়ে৷ গোর্খাল্যান্ডের দাবিকে ঘিসিং ঠান্ডা ঘরে পাঠিয়ে দিয়েছেন , এ কথা বোঝার পরেই পাহাড়ে ক্ষোভ বাড়তে শুরু করেছিল ঘিসিং -এর বিরুদ্ধে৷ সেই ক্ষোভকেই কাজে লাগান গুরুং৷ পাহাড়ছাড়া করেন ঘিসিংকে৷ আজ গুরুং নিজেই ঘরছাড়া৷
বিমল গুরুংকে হঠাতে বিনয় তামাংকে তোলা হচ্ছে এ বার৷ রাজ্য প্রশাসনের অকুণ্ঠ আশীর্বাদ মাথায় নিয়ে তামাং জিটিএ -র শীর্ষ পদে বসেছেন৷ শুরু করে দিয়েছেন বিমল গুরুংকে বিচ্ছিন্ন করে দেওয়ার প্রক্রিয়া৷ কিন্ত্ত তামাং খুব ভালো ভাবেই জানেন , পাহাড়ের রাজনীতিতে টিকে থাকতে গেলে আজ না হোক কাল গোর্খাল্যান্ডের দাবিতে সরব হতে হবে তাঁকেও৷ সে দিন কিন্ত্ত বিনয় তামাংও কলকাতার চক্ষুশূল হয়ে উঠবেন৷ তামাং নিজেও সম্ভবত সেই ভবিষ্যত্টা দেখতে পাচ্ছেন৷ তবে মোকাবিলার কৌশল তিনি সাজাচ্ছেন কি না , সে খুব স্পষ্ট নয় এখনও৷
লেখক আইনজীবী৷ মতামত ব্যক্তিগত
বাঙালিদের চোখে দার্জিলিং, কালিম্পং, কার্শিয়াং-এর গোর্খারা খুব ভালো মানুষ৷ কারণ সমতলের মানুষদের পর্যটনের জন্য গোর্খাদের পাহাড়টা সত্যিই সুন্দর৷ পাহাড়ে বেড়াতে গিয়ে বাঙালিরা উপলব্ধি করেন , গোর্খাদের আতিথেয়তার কোনও তুলনা নেই৷ তাই বাঙালিরা চান, গোর্খাদের উন্নতি হোক , পাহাড়ের ভালো হোক৷ বাংলা থেকে দার্জিলিংকে গোর্খারা বিচ্ছিন্ন করতে চান, এ কথা বহু দশক ধরে জানা সত্ত্বেও বাঙালিরা গোর্খাদের ভালো চান-এমন একটা ধারণাও কিন্ত্ত বাঙালিদের মধ্যে রয়েছে৷ এই ধারণার বশবর্তী হয়ে বাঙালিরা নিজেদের বেশ মহত্ ও উদার মনে করেন এবং শ্লাঘা বোধ করেন৷ আসলে কিন্ত্ত এতটা শ্লাঘার অবকাশ নেই৷ পরিস্থিতিটা একটু তলিয়ে বোঝার চেষ্টা করলে রায়বাহাদুর থেকে রামা কৈবর্ত পর্যন্ত সকলেই বুঝতে পারবেন , পাহাড়ের প্রতি বা পাহাড়ের মানুষের প্রতি বাঙালির এই অনুভূতি কোনও সংহতির বোধ থেকে উত্সারিত নয়৷ এ আসলে খানিকটা করুণা -মিশ্রিত কল্যাণেচ্ছা৷ ব্রিটিশদের মধ্যেও বাঙালিদের প্রতি অনেকটা এই রকম অনুভূতিই ছিল৷
গোর্খারা কিন্ত্ত বাঙালির করুণার পাত্র নন, তাঁরা করুণা চান-ও না৷ গোর্খারা নিজেদের হকটা আদায় করে নিতে চান৷ আর বাঙালি বলে , নিজের ভালো পাগলেও বোঝে , শুধু গোর্খারাই বোঝেন না৷ প্রশ্ন হল , গোর্খাদের ভালো কীসে, সেটা বাঙালির চোখ দিয়ে দেখলে কী ভাবে বোঝা যাবে ? গোর্খার চোখ দিয়ে দেখার চেষ্টা করতে হবে পরিস্থিতিটাকে৷ না হলে কিছুতেই বোঝা যাবে না মাঝে-মধ্যেই কেন আগুন জ্বলে ওঠে দার্জিলিং , কালিম্পং , কার্শিয়াঙে৷
ব্রিটিশ আমলে আমাদের দেশের মানুষের সমস্যাকে ইংরেজরা তাঁদের নিজেদের চোখ দিয়ে দেখার চেষ্টা করতেন৷ দৃষ্টিভঙ্গিতে গলদ থেকে যেত সেখানেই৷ ভারতীয়দের উন্নতি হোক , অনেক ইংরেজই হয়তো তা চাইতেন৷ সে সময়ের শিক্ষিত ভারতীয়দের প্রতি, বিশেষত শিক্ষিত বাঙালির প্রতি ব্রিটিশদের একটা করুণা মিশ্রিত সহমর্মিতা ছিল৷ কারণ শিক্ষিত বাঙালি আপ্রাণ চেষ্টা করতেন ব্রিটিশদের অনুকরণ করার , সাহেবি আদব -কায়দা রন্ত করার৷ এ সব যত ভালো ভাবে রন্ত করা যাবে , ততই ব্রিটিশদের কাছে যাওয়া যাবে --- ধারণা ছিল আমাদের৷ বাঙালিদের এই আনুগত্য স্বাভাবিক ভাবেই ব্রিটিশদের ভালো লাগত৷ কিন্ত্ত সেই ভালো লাগা ব্রিটিশ শাসককে কখনওই রাজা -প্রজার মধ্যবর্তী ভেদরেখা মুছে দিতে অনুপ্রাণিত করেনি৷ ব্রিটিশরা কখনওই বাঙালিকে বা অনুগত ভারতীয়কে নিজেদের স্তরে তুলে নিয়ে গিয়ে প্রশাসন চালানোর কথা ভাবেননি৷ তাই ব্রিটিশ আমলে কলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতি আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের মেধা ইংরেজদের কাছে অত্যন্ত সমাদৃত হলেও , তাঁকে কখনও প্রধান বিচারপতি পদে বসতে দেওয়া হয়নি৷ একই ভাবে ব্রিটিশ ফেডারেল কোর্টেও কোনও বাঙালি বা ভারতীয় বিচারপতিকে খুঁজে পাওয়া যেত না৷ শীর্ষ প্রশাসনিক পদগুলিতেও বাঙালিরা এবং ভারতীয়রা ব্রাত্য ছিলেন৷
একই ভাবে স্বাধীনতার পরে কোনও গোর্খাকে কলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতি করার কথা কেউ ভাবেননি৷ পুলিশ -প্রশাসনের সর্বোচ্চ পদেও তাঁদের কখনও নিয়োগ করা হয়নি৷ ওঁরা আমাদের ‘ভাই ’, কিন্ত্ত রাজ্যের সর্বোচ্চ পদে ওঁদের পাঠানোর কথা আমরা ভাবতেই পারি না৷
সমাজতত্ত্ববিদ হোমি কে ভাবা তাঁর বই ‘লোকেশন অব কালচার ’-এ লিখেছেন , ‘যখনই আমরা অন্য কোনও ব্যক্তির বিচার করি , তখনই আমাদের নিজেদের বিশ্বাস এবং ধারণা আমাদের দৃষ্টি এবং বিচারবুদ্ধিকে মেঘাচ্ছন্ন করে দেয়৷ ব্যক্তি হিসেবে আমরা সব সময় নিজেদের পথটাকেই সঠিক পথ বলে মনে করি৷ আর যে বা যাঁরা অন্য ভাবে ভাবনা -চিন্তা করেন , তাঁদের সব সময়ই যুক্তিহীন ও বেঠিক বলে মনে করি এবং বিশ্বাস করি যে এঁদের জন্য আমাদের সময়ের অপব্যয় হওয়া উচিত নয়৷ এটা আরও বেশি সত্য হয়ে ওঠে তখন , যখন ভিন্নমতের ব্যক্তিটি জাতিগত ভাবে বা সামাজিক ভাবে বা অর্থনৈতিক ভাবে আমাদের চেয়ে পিছিয়ে থাকেন৷ আমরা সে ক্ষেত্রে পৃথিবী সম্পর্কে আমাদের নিজেদের ধারণার প্রেক্ষাপটে ফেলে তাঁদের বিচার করি , তাঁদের ভাবনা বা দৃষ্টিভঙ্গি একেবারেই বিচার করি না৷ ’ ভাবা নিজের বইতে ‘নকলনবীশ ’দের নিয়ে অনেক কথা লিখেছেন৷ লেখকের ভাষায় , ‘Mimic Men’৷ হোমি কে ভাবার ব্যাখ্যা --- ব্রিটিশরা ভারতে এক বিশেষ প্রজাতির মানুষ তৈরি করেছিলেন , যে প্রজাতি ছিল শাসক ব্রিটিশ এবং শাসিত ভারতীয়ের মধ্যে সংযোগ রক্ষা করার সেতু৷
ভাবা লিখেছেন , ‘এঁরা মূলত বাঙালি ছিলেন এবং সব রকম ভাবে ব্রিটিশদের নকল করতেন , ব্রিটিশ কাঠামোর মধ্যে উপরে ওঠার তাগিদে এঁরা ব্রিটিশদের জীবনযাত্রা ,জীবনধারা এবং চিন্তা -ভাবনার প্রক্রিয়াকেও নকল করতেন৷ কিন্ত্ত ব্রিটিশরা সর্বদাই এঁদেরকে নিজেদের চেয়ে হীন হিসেবে দেখতেন এবং কখনওই সম্পূর্ণ আপন করে নিতেন না৷ এক দিকে এঁদের বলা হত , ব্রিটিশদের সঙ্গে যত বেশি তাঁরা মিশে যেতে পারবেন , তাঁদের উন্নতির সম্ভাবনা ততই বাড়বে৷ অন্য দিকে যখনই পদোন্নতির বা উচ্চপদে আসীন হওয়ার সুযোগ আসত , তখন সেগুলো ব্রিটিশরাই পেতেন , তাঁদের অনুকরণকারীরা নন৷ ’গোর্খাদের প্রতি বাঙালির আচরণও কিন্ত্ত অনেকটা এই রকমই৷ গোর্খারা ততক্ষণই ভালো , যতক্ষণ তাঁরা বাঙালির অনুগত৷ বাংলার তথা বাঙালির সরকার এতই ‘উদার ’ যে, পাহাড়ের ছেলে -মেয়েরা স্কুলে নেপালি ভাষায় লেখাপড়া করার সুযোগ পাচ্ছে৷ শুধু চতুর্থ ভাষা হিসেবে তাদের বাংলা পড়তে বলা হচ্ছে৷ কিন্ত্ত সমতলের ছেলে -মেয়েদের কখনওই বলা হচ্ছে না , তৃতীয় বা চতুর্থ ভাষা হিসেবে নেপালিটা শিখতে হবে৷ সমতলের মানুষ পাহাড়ে বেড়াতে যাচ্ছেন , সরকারি উদ্যোগে পাহাড়ে পর্যটন পরিকাঠামো নাকি বাড়ছে , তাতে নাকি গোর্খাদের খুব উন্নতিও হচ্ছে৷ কিন্ত্ত একটু খোঁজ নিলেই জানা যাচ্ছে , পাহাড়ের হোটেল -রেস্তোরাঁ-লজ -গেস্ট হাউজগুলির প্রায় কোনওটিই আসলে গোর্খাদের নয়৷ নামে বা বেনামে সে সবের মালিকানা সমতলের মানুষের হাতে৷ এর পরেও গোর্খাদের মধ্যে ক্ষোভ থাকবে না ?ভাষার ভিত্তিতে রাজ্য গঠনের দাবি ভারতে নতুন নয়৷ বরং ভারত স্বাধীন হওয়ার পর থেকে যতগুলি রাজ্য ভাগ হয়েছে , সেগুলির অধিকাংশই ভাগ হয়েছে ভাষার ভিত্তিতে৷
বম্বে ভেঙে তৈরি হয়েছে মহারাষ্ট্র ও গুজরাত৷ পঞ্জাব ভেঙে তৈরি হয়েছে হরিয়ানা৷ অসমকে সাতটি রাজ্যে ভাগ করা হয়েছে৷ সুতরাং ভাষার ভিত্তিতে গোর্খাল্যান্ড রাজ্য গঠনের দাবি তোলা অযৌক্তিক কিছু নয়৷ মাত্র তিন -চারটি বিধানসভা কেন্দ্র নিয়ে একটা গোটা নতুন রাজ্য গঠন করা সম্ভব কিনা , সে অন্য প্রশ্ন৷ সুবিশাল রাজ্য পশ্চিমবঙ্গের খুব ছোটো একটি এলাকায় গোর্খারা সংখ্যাগরিষ্ঠ বলেই সেই অঞ্চলকে আলাদা রাজ্যের মর্যাদা দিয়ে দিতে হবে , এমন দাবিকে অযৌক্তিক মনে হতেই পারে৷ সে ক্ষেত্রে রাজ্য সরকারের উচিত , যুক্তি দিয়ে সে কথাই বুঝিয়ে বলা৷ কিন্ত্ত আন্দোলনকারীদের সঙ্গে আলোচনাতেই বসব না , এমন কথা সরকার বলতে পারে না৷ গোড়া থেকেই যেন মারমুখী মেজাজে সরকার , পরিস্থিতি আরও বেশি জটিল হয়েছে সেই কারণেই৷
আসলে সমতলের কিছু মানুষ পাহাড়িদের চিরকাল বশংবদ হিসেবে দেখতে অভ্যস্ত৷ আমাদের পছন্দ নয় এমন কোনও দাবি তুললেই পাহাড়িদের উপর খড়্গহস্ত হয়ে উঠি আমরা৷ সুবাস ঘিসিং পৃথক গোর্খাল্যান্ড চেয়ে সরব হতেই তদানীন্তন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুর পুলিশ প্রবল বিক্রমে ময়দানে নেমে পড়েছিল পাহাড় শাসন করতে৷ ব্যাপক পুলিশি অত্যাচারের মুখে ঘিসিং সমঝোতায় আসতে বাধ্য হন৷ তত্ক্ষণাত্ তাঁকে দার্জিলিং গোর্খা পার্বত্য পরিষদের (ডিজিএইচসি ) মাথায় বসিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা হয় এবং ডিজিএইচসি -র হাতে প্রচুর টাকা দিয়ে ঘিসিংকে পকেটে পুরে ফেলা হয়৷ পাহাড়ের উন্নয়নের নামে যে বিপুল পরিমাণ টাকা ঘিসিংদের দেওয়া হত , তার হিসেব কিন্ত্ত চাইত না রাজ্য সরকার৷
দীর্ঘ দিন ঘিসিং -রাজ চলার পর বিমল গুরুংয়ের উত্থান পাহাড়ে৷ গোর্খাল্যান্ডের দাবিকে ঘিসিং ঠান্ডা ঘরে পাঠিয়ে দিয়েছেন , এ কথা বোঝার পরেই পাহাড়ে ক্ষোভ বাড়তে শুরু করেছিল ঘিসিং -এর বিরুদ্ধে৷ সেই ক্ষোভকেই কাজে লাগান গুরুং৷ পাহাড়ছাড়া করেন ঘিসিংকে৷ আজ গুরুং নিজেই ঘরছাড়া৷
বিমল গুরুংকে হঠাতে বিনয় তামাংকে তোলা হচ্ছে এ বার৷ রাজ্য প্রশাসনের অকুণ্ঠ আশীর্বাদ মাথায় নিয়ে তামাং জিটিএ -র শীর্ষ পদে বসেছেন৷ শুরু করে দিয়েছেন বিমল গুরুংকে বিচ্ছিন্ন করে দেওয়ার প্রক্রিয়া৷ কিন্ত্ত তামাং খুব ভালো ভাবেই জানেন , পাহাড়ের রাজনীতিতে টিকে থাকতে গেলে আজ না হোক কাল গোর্খাল্যান্ডের দাবিতে সরব হতে হবে তাঁকেও৷ সে দিন কিন্ত্ত বিনয় তামাংও কলকাতার চক্ষুশূল হয়ে উঠবেন৷ তামাং নিজেও সম্ভবত সেই ভবিষ্যত্টা দেখতে পাচ্ছেন৷ তবে মোকাবিলার কৌশল তিনি সাজাচ্ছেন কি না , সে খুব স্পষ্ট নয় এখনও৷
লেখক আইনজীবী৷ মতামত ব্যক্তিগত